সচেতনতার পরম্পরায় সুস্থ থাকার উপায়

সচেতনতার পরম্পরায় সুস্থ থাকার উপায়

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে পুরো বিশ্বই এক গভীর সংকটে পড়েছে। এর মধ্যে “মরার উপর খরার ঘা” হিসেবে দেখা দিয়েছে নতুন এক ভাইরাস। ভাইরাসটির প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা দোদুল্যমান। কখনও কমছে আবার বাড়ছে। কিংবা নতুন রূপে ভয়ার্ত থাবা দিচ্ছে। কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না, কবে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) থেকে মুক্তি মিলবে! এর মধ্য়েই কি চোখ রাঙাচ্ছে করোনার থেকেও আরও প্রাণঘাতি এক ভাইরাস? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন এই ভাইরাস সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, নতুন এই ভাইরাসটি করোনভাইরাসের থেকেও বেশি প্রাণঘাতি।

ভয়াবহ নতুন এই ভাইরাসটি’র নাম

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর মতে বাংলাদেশ, ভারত ও এশিয়া অঞ্চলে ‘নিপাহ ভাইরাস’ আরো একটি মহামারির কারণ হতে পারে। এই ভাইরাসটি অনেক বেশি সংক্রামক। যেকোনো সময় যেকোনো অঞ্চলের জনবসতির ভেতর ব্যাপক আকারে এটির প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শীত মৌসুম শুরু হতে-না-হতেই দেশে নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব উদ্বেজনক। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার “সুঙ্গাই নিপাহ”গ্রামে প্রথম এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়। সেখানে বাড়ির পোষ্য কুকুর, বিড়াল, ঘোড়া, ছাগলের দেহে এই ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ওই অঞ্চলে প্রতিটি বাড়িতেই শূকর প্রতিপালন হয়। গবেষণার পর দেখা যায়, শূকর থেকেই নিপাহ ভাইরাস ছাড়িয়েছে পোষ্যদের দেহে। ২০১৮ সালে পার্শ্ববর্তী ভারতের কেরালায় এই ভাইরাসের প্রকোপে ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ভাইরাসটি আবিষ্কার করেন ড: কো বিং চুয়া।

এরপর ১৯৯৯ সালে সিঙ্গাপুরে এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা যায়। সে সময় দেশ দুটিতে ২৭৬ জনের মৃত্যুর তথ্য রয়েছে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা গেছে। দেশে নিপাহভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ঘটেছিল ২০০১ সালে। বাংলাদেশ ও ভারতে বাদুর থেকে মানুয়ের শরীরে এসব ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। আইইডিসিআরের তথ্যানুযায়ী, ওই বছর নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হন ১৩ জন এবং তাদের মধ্যে ৯ জনের মৃত্যু ঘটে। এরপর ২০০৪ সালে ৬৭ জন আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এভাবে গত ২০ বছরে দেশে জীবননাশী এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন ৩১৯ জন এবং তাদের মধ্যে মারা গেছেন ২২৫ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণজনিত রোগটি বিশ্বে মহামারী সৃষ্টি করতে পারে। যদিও প্রতিষেধক হিসেবে এর ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, তবে কবে নাগাদ তা পাওয়া যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় সচেতনতাই ভাইরাসটির বড় প্রতিষেধক। প্রধানত বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়ানো এ ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশের পর এনকেফালাইটিস (মস্তিষ্কের প্রদাহ) নামক রোগ সৃষ্টি করে। মূলত শীতকালে খেজুরের রস সংগ্রহের সময় নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে বাদুড়ের দল খেজুরের রস পান করার চেষ্টাকালে রসের সঙ্গে তাদের লালার সংমিশ্রণ ঘটে। পরে এ রস যখন মানুষ পান করে, তখনই ঘটে বিপত্তি। মানুষ নিজের অজান্তেই সংক্রমিত হয় প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে। তবে খেজুরের রস ছাড়াও বাদুড়ের আধখাওয়া ফল ও নিপাহভাইরাসে আক্রান্ত কোনো মানুষ থেকেও এ ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।

নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে, জ্বর, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, বমিভাব, গলাব্যথা, কাশি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। রোগের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত করায় তীব্র জ্বরের পাশাপাশি রোগী অচেতন হয়ে পড়ে। একইসঙ্গে খিঁচুনি ও প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এসব লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন। তাছাড়া রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ায় আক্রান্তদের পরিচর্যার সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যদিও, অন্যান্য ছোঁয়াচে রোগের মতো নিপাহ এনকেফালাইটিসও প্রতিরোধ করা সম্ভব। নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য কোন এখন পর্যন্ত কোন টিকা আবিস্কার করা যায়নি। এমনকি এ রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিত্সা নেই। রোগের লক্ষণ দেখা মাত্রই রোগীকে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এলাইজা টেস্ট, পিসিআর, সেল কালচার প্রভৃতি প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে এই ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে প্রয়োজনে আইসিইউও রাখতে হতে পারে। সাধারণত লক্ষণ অনুযায়ী চিকিত্সা দিতে হয়। প্রয়োজনে এন্টিভাইরাল ব্যবহার করা যায়। আক্রান্ত রোগীর দ্রুত চিকিত্সার ব্যবস্থা করলে জীবন রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

নিপাহ ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য প্রসেডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস (পিএএনএস) এবং প্রতিবেদনটি সম্পাদনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেক্সশাস ডিজিজেসের পরিচালক এবং বিখ্যাত সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউচি। তারা দীর্ঘ ৬ বছর ধরে বাংলাদেশের ২ হাজার ৭০০ বাদুড়ের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছেন। এতে বিজ্ঞানীরা ভাইরাসটির এমন স্ট্রেইন পেয়েছেন, যা এই বিপদের কারণ হতে পারে। গত জানুয়ারিতে প্রতিবেদনটি গ্রহণ করা হয়। এরপর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি অনুমোদন দেয়া হয় এবং জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে গত ২ নভেম্বর। প্রাথমিক পর্যায়ে ধারণা করা হয়েছিলো, মূলত বাদুর থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। তবে এখন বিজ্ঞানীরা ভিন্ন কথা বলছেন। তাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, যে সব অঞ্চলে খেজুর গাছ নেই সেখানেও রোগটি দেখা গেছে। এমনকি এমনও রোগী পাওয়া গেছে, যারা কখনই খেজুরের রস পান করেননি। প্রতিবেদনে গবেষকেরা বলেছেন, ভাইরাসটি দিনে দিনে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে সংক্রমণের সহজ স্ট্রেইন তৈরি হয়ে যাচ্ছে। নিপাহ ভাইরাস বাংলাদেশ-ভারতের ঘনবসতি অঞ্চলে প্রায় প্রতি বছর দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, দক্ষিণ ভারতের কেরালায় ২০১৮ সালে ১৮ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ১৭ জনই মৃত্যুবরণ করেন। এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ। ২০০১ সাল থেকে প্রতিবছরই বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে। গত ২০ বছরে ৩০৩ জন ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং এদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই মারা গেছেন। যারা বেঁচে আছেন, তারা নানা ধরনের স্নায়ুগত জটিলতায় ভুগছেন।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ভারতে ১২ বছরের এক ছেলে শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বিরল এই ভাইরাসটি কোভিড-১৯ ভাইরাসের চেয়েও অনেক বেশি প্রাণঘাতী। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা দীর্ঘ দিন থেকেই আশঙ্কা করে আসছেন নিপাহ ভাইরাসের কারণে বিশ্ব জুড়ে মহামারি শুরু হতে পারে। গত ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায় মৃত্যু হয় ছেলে শিশুটির। করোনাভাইরাসের মহামারিতে ভারতের এই রাজ্যটিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৃত্যুর আগে আরও দুইটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় শিশুটি। ফলে আরও শত শত মানুষ তার সংস্পর্শে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্তত ১১ জনের শরীরে ইতোমধ্যে লক্ষণ দেখা গেছে। এশিয়া অঞ্চলের নিপাহ ভাইরাস ‘আরেকটি মহামারীর কারণ হতে পারে’বলে সতর্ক করেছেন মার্কিন গবেষকেরা। যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য প্রসেডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’বা পিএএনএস-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আগে যতোটা ধারণা করা হয়েছিল এই ভাইরাস তার থেকে বেশি সংক্রামক। যেকোনো সময়, যেকোনো অঞ্চলের জনবসতির ভেতর ছড়িয়ে পড়তে পারে।

মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে একের পর এক জেঁকে বসছে নতুন নতুন রোগ৷ ফলে বিজ্ঞানীরা এক রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের পর স্বস্তির নিশ্বাস না ফেলতেই আরেক নতুন রোগ এসে হাজির৷ এমনই এক নতুন ভাইরাস ‘নিপাহ’ হানা দিয়েছে বাংলাদেশেসহ পৃথিবীর বহুদেশে। নিপাহ অপেক্ষা-কৃত নতুন ভাইরাস, যা অতি সহজেই বাদুড় জাতীয় তৃণভোজী প্রাণী থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। শুধুমাত্র বাদুড় নয়, নিপাহ শূকরের বর্জ্য থেকেও ছাড়াতে পারে। খেজুর ও তালের কাঁচা রস পরিহারের পাশাপাশি বিভিন্ন কাঁচা ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনসহ পাখি বা বাদুড়ে খাওয়া ফল ভক্ষণ না করাই বাঞ্ছনীয়। বস্তুত নিপাহ ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক না থাকায় জনসচেতনতা এবং সতর্কতা এই ভাইরাস থেকে দূরে থাকার প্রধান উপায়৷ ভয়াবহ এই ভাইরাসের ছোবল থেকে বাঁচতে হলে সম্মিলিতভাবে সচেতন হতে হবে। দেশের মানুষ, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে নিপাহ ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে-এটাই প্রত্যাশা।।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।

ইমেইল: jsb.shuvo@gmail.com

editor