কাহালুর তালপাখা: বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী এই পাখা এখন সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে

কাহালুর তালপাখা: বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী এই পাখা এখন সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে

চপল সাহা,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের আড়োলা, আতালপাড়া, যোগীরভবন সহ আশে পাশের গ্রাম গুলোতে বিভিন্ন প্রকারের তালপাতার পাখা তৈরীর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আবাল বৃদ্ধ বনিতারা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও মাঘ মাস থেকে তালপাতার পাখা তৈরীর কাজ শুরু করেছে এখানকার পাখা তৈরী কারকরা। বংশ পরম্পরায় শত শত বছর আগে থেকে এখানকার মানুষরা তালপাতার পাখা তৈরী করে আশায়, এ গ্রাম গুলো বিভিন্ন জেলার মানুষের কাছে তালপাখার গ্রাম নামেই পরিচিত। তালপাখার গ্রাম গুলো ঘুরে লক্ষ করা গেছে শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত বসে নেই। নারী-পুরুষ মিলে সবাই তৈরী করছে বিভিন্ন প্রকারের সৌখিন তালপাতার হাত পাখা। প্রতি বছরের মত এবারও ভাদ্র মাস পর্যন্ত এখানকার পাখা তৈরী কারকদের এই ব্যস্ততা থাকবে জানা গেছে। গরমের তীব্রতা যত বাড়বে ততই বাড়বে পাখা তৈরী কারকদের ব্যস্ততা। কারন একটায় বিদ্যুৎ বিহীন অবস্থায় মানুষজন যখন গরমে ওষ্ঠাগত তখন একমাত্র ভরসা এই তালপাতার পাখা। তার উপর পুরো বোরো মৌসুমে জুড়েই থাকে বিদ্যুৎ সমস্যা। যারফলে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা ছুটে আসছে এখান থেকে পাখা কেনার জন্য। এখানকার ৪/৫ টি গ্রামের প্রায় ৫”শ” পরিবার তালপাতার পাখা তৈরী করে থাকে। এদের মধ্যে কেউ শ্রমিক হিসেবে আবার কেউ নিজের তহবিলে পাখা তৈরী করেন। আবার স্থানীয় কয়েক জন মহাজন শ্রমিক খাটিয়ে প্রতি মৌসুমে ৩০/৪০ হাজার পাখা তৈরী করে নিয়ে বড় বড় ব্যাবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে থাকে। এখানে প্রকারভেদে ৫ প্রকারের পাখা তৈরী হয়। এসব পাখার নাম দেওয়া হয়েছে ডাটা পাখা, হরতন পাখা, ঘুরকি পাখা, পকেট পাখা ও আমান পাখা। এখানে পাখা তৈরীর ক্ষেত্রে মহিলারাই অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। পুরুষেরা বাহিরের কাজ কর্ম শেষে পাখা তৈরী করলেও মহিলারা রান্না বান্না ছাড়া সব সময়ই পুরো মৌসুম পাখা তৈরীর কাজে ব্যস্ত থাকেন। এখানকার মহিলারা বাড়তি আয়ের জন্য বিভিন্ন মহাজনের পাখা তৈরী করে। চুক্তি ভিত্তিক ১”শ” পাখা তৈরী করলে তারা পাখার প্রকারভেদে ৬০ থেকে  ১”শ” পায়। চুক্তি ভিত্তিক পাখা তৈরী কারক মরিয়ম, রেহেনা, হাজেরা সহ একাধিক মহিলা জানান পাখা তৈরী থেকে শুরু করে পাখা তৈরীর আনুষঙ্গিক কাজের উপর নির্ভর করে তারা পারিশ্রমিক পায়। মহাজন আব্দুল লতিফ জানান তারা সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন তালপাতা সংগ্রহ করাসহ পাখা তৈরীর কাজে। পাখা তৈরীর শুরুর ২/৩ মাস আগে থেকে নওগাঁ ও জয়পুরহাট জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে তালপাতা কিনে এনে মজুদ করে। সুযোগ বুজে পাখা তৈরী করে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারী দরে বিক্রি করে। তাদের ভাষ্যমতে এখানকার তৈরী করা তালপাখা রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জেলা বিক্রি হয়। প্রতি মৌসুমে এখানকার স্থানীয় মহাজনেরা এই ব্যবসায় ৫০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করে। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে পাখা কিনতে আসা ব্যবসায়ী আবু বক্কর ও সিরাজুল ইসলাম জানান বাংলাদেশে যত তালপাতার পাখা তৈরী হয় তার বেশীর ভাগই এখানে তৈরী হয় বলে তাদের ধারনা। বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে পাখা কিনতে আসা ব্যবসায়ীদের মতে তালপাতার এই সৌখিন পাখা গুলো সবচেয়ে বেশী বিক্রি হয় বিভিন্ন মেলাতে। এলাকার প্রবীনদের ধারনামতে যোগীর ভবনের যে প্রচীন যগী ঋৃষীর মন্দির রয়েছে। সেখানে প্রাচীনকালে পুজা পার্বনে বড় মেলা বসতো। সেই মেলা উপলক্ষে হাতে গোনা কিছু লোক পাখা তৈরী করতো। আগে সখের বসত্ব তারা পাখা তৈরী করে মেলাতে বিক্রি করতো। পরবর্তিতে এই পাখা তৈরীর কাজে অনেকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। এখানকার তৈরী কারকদের মতে তাদের বাপ দাদার আদি পেশা এই পাখা তৈরীর কাজ। যার ফলে ৮ বছরের শিশু পর্যন্ত পাখা তৈরী করতে পারে। এখানকার পাখা তৈরী কারকদের  মতে আধুনিকতার ছোঁয়া সব জাগাতে লাগলেও তাদের তৈরী করা পাখার চাহিদা একটুও কমেনি। দিন যতই যাচ্ছে ততই তাদের তৈরী করা পাখার চাহিদা বাড়ছে। গরমের সময় তাদের পরিবারের সকল সদস্য পাখা তৈরীর কাজ করেও বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের চাহিদা মেটাতে পারেনা।

বিশেষ প্রতিনিধি