বিজয়ের ৪২ বছরে পা রাখলো জাতিঃ বিজয় নিশান ঘরে ঘরে

বিজয়ের ৪২ বছরে পা রাখলো জাতিঃ বিজয় নিশান ঘরে ঘরে

কাজী মাহফুজুর রহমান শুভ,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ রক্তনদী পেরিয়ে আসা আনন্দ-বেদনায় মিশ্র মহান বিজয় দিবস আজ। বিজয়ের গৌরবের-বাঁধভাঙ্গা আনন্দের দিন। একই সঙ্গে লাখো স্বজন হারানোর শোকে ব্যথাতুর-বিহ্বল হওয়ারও দিন। তীব্র শোষণের কুহেলী জাল ভেদ করে একাত্তরের এই দিনটিতে প্রভাতী সূর্যের আলোয় ঝিকমিকিয়ে উঠেছিল বাংলার শিশিরভেজা মাটি। অবসান হয়েছিল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সাড়ে তেইশ বছরের নির্বিচার শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতনের কালো অধ্যায়। নয় মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে এদিন জন্ম নেয় একটি নতুন দেশথ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। ঝড়ের ভেতরে বিকশিত অটল বৃক্ষের জীবনত্ম প্রতীক স্বাধীনতা নামের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আজও প্রচ- ঝাঁকি দেয় রক্তে, শাণিত করে চেতনা। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ দেশে ৪১ বছর আগে আজকের এই দিনে উদয় হয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সূর্য। সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিল নতুন দিনের স্বপ্ন, যে স্বপ্নে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ। আজ ৪১ বছর পরও সেই স্বপ্ন বাসত্মবে রূপ পায়নি, শেষ হয়নি মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম। বিজয়ের আনন্দের এই দিনে শহীদ পরিবারের সদস্যদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থামেনি। গণহত্যা ও ধর্ষণের বিচারের জন্য তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তাঁরা। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম যুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে দাবি তুলেছিল, আজও তা বাসত্মবায়ন হয়নি। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে পথচলাও এখনও শেষ হয়নি। তবে এবার নতুন আশায় বুক বেধেছে দেশের মানুষ। নতুন চেতনা ও ভিন্ন রকম আবহে এবার জাতি পালন করছে মহান বিজয় দিবস। যে নেতার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালী জাতি পেয়েছে এই মহামূল্যবান স্বাধীনতা, সেই মহান নেতা বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরই হাতে গড়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকারই ছিল স্বাধীনতা বিরোধী নরঘাতক রাজাকার-আলবদর-আলশামস যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে কথা রাখছেন। গণমানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন- বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই হবে। ইতোমধ্যে চলছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। কারাপ্রকোষ্ঠে অনত্মরীণ করেছে একাত্তরের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদী গংকে। গ্রেফতারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযম, সাকা চৌধুরীরা। তাই স্বজন হারানো মানুষ নতুন আশায় বুক বেঁধেছে, এবার বিচার হবে সেই নরপশু রাষ্ট্রদ্রোহী যুদ্ধাপরাধী ঘাতকদের। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অসত্মমিত হয়েছিল সেটির উদয় ঘটে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে। বহু শতাব্দীর স্বপ্নথ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে। অবর্ণনীয় দুর্যোগে লন্ডভন্ড হওয়া বাংলাদেশের বঞ্চিত ও শোষিত মানুষ রুখে দাঁড়ায় সর্বশক্তি দিয়ে। আত্মবিস্মৃত বাঙালী আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে উৎসর্গ করে নিজ ও স্বজনকে। ছিনিয়ে আনে বিজয়, লাল-সবুজ পতাকাসংবলিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার। এদিনের সকালে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের কর্মকর্তা জন আর কেলি পৌঁছান সেনানিবাসের কমান্ড বাংকারে। সেখানে নিয়াজী নেই, ফরমান আলীকে পাওয়া গেল বিবর্ণ ও বিধ্বসত্ম অবস্থায়। নিচু কণ্ঠে ফরমান আলী জানান, আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত ভারতীয় বাহিনীর প্রস্তাব তাঁরা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় ভারতে সেই সংবাদ পাঠাতে পারছেন না। কেলি প্রসত্মাব দিলেন, জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহার করে তিনি বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন। আত্মসমর্পণের জন্য বেধে দেয়া সময় সকাল সাড়ে নয়টা থেকে আরও ছয় ঘণ্টা বাড়ানো ছাড়া ভারতীয় বাহিনীর সব প্রসত্মাব মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণের বার্তা পৌঁছানো হয় জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহার করে। ভারতে তখন সকাল নয়টা ২০ মিনিট। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের একটি দোতলা বাড়ি। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিবালয় আর প্রধানমন্ত্রীর দফতর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল। বরাবরের মতো সেদিনও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কক্ষের দরজা একটু খোলা। উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী অভ্যাসবশে ডান হাতের আঙ্গুল কামড়াচ্ছেন। আনুমানিক সকাল ১০টায় তাজউদ্দীন আহমদের ফোনটি বেজে উঠল। ওই ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছাড়া ফোন করতে পারে না। কি কথা হলো বোঝা গেল না। কিন্তু ফোন রেখে, চোখেমুখে সব পাওয়ার আনন্দ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানালেন- ‘সবাইকে জানিয়ে দাও, আজ আমরা স্বাধীন। বিকাল চারটায় আত্মসমর্পণ।’ প্রধানমন্ত্রী নিজেই অবশ্য খবরটি সবাইকে শোনালেন। আর বললেন, কাজের প্রথম পর্যায় শেষ হলো কেবল। এবার দ্বিতীয় পর্যায় দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসতে সবাইকে।’

আজ রোববার ঢাকায় প্রত্যুষে ৪১ বার তোপধ্বনির মধ্যদিয়ে মহান বিজয় দিবসের সূচনা হবে। আজ সরকারী ছুটির দিন। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে নামবে কৃতজ্ঞ জনতার ঢল। বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মহান ত্যাগের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞ জাতি শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবে। দেশব্যাপী আজ সকল ভবনের শীর্ষে উড্ডীন থাকবে জাতীয় পতাকা। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান মহান বিজয় দিবসের বাণীতে বলেন, মহান বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে এক গৌরবের দিন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীর স্বাধীনতার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, দীর্ঘ ন’মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে এ দিন তা চূড়ানত্ম সাফল্য লাভ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে মহান বিজয় দিবসে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়নত্মী উদযাপিত হবে। এই সুবর্ণজয়নত্মীকে সামনে রেখে আসুন দল-মত-শ্রেণী-পেশা ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করি।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএনপি চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার বাণীতে বলেন, শোষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়েই ১৯৭১-এ এদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে আমাদের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, জনগণের মৌলিক ও মানবিক অধিকার খর্ব হয়েছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক বাণীতে বলেছেন, আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বতন্ত্র মহিমা ও মহত্বমন্ডিত মহোৎসবের দিন ছিলো ’৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর; যা আমাদের শ্রেষ্ঠতম গৌরবময় বিজয়ের দিন। বাংলাদেশের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায় এই মহান বিজয় দিবস। পরাধীনতার শৃঙ্খল চুর্ণ বিচুর্ণ করে অকুতভয় মুক্তিযোদ্ধারা ৯ মাসের সংগ্রামের পর অশ্র“মাখা ও রক্তে ভেজা এই শ্যামল বাংলাদেশের মাটিতে এক মহেন্দ্রক্ষণের জন্ম দিয়ে আমাদের কাক্সিক্ষত বিজয় এনে দিয়েছে।

নিজস্ব প্রতিনিধি