সিলেটে ব্যাটারিচালিত রিকশাঃ লোডশেডিং এর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা

সিলেটে ব্যাটারিচালিত রিকশাঃ লোডশেডিং এর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা

সুমন দে,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ ২০০৯ সালের প্রথমদিকে চালু হয়েছিল ব্যাটারিচালিত অটোবাইক। সেই সময়ে এইসব ব্যাটারিচালিত অটোবাইক নিয়ে বিদ্যুতের লোডশেডিংসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তখন এইসব ব্যাটারিচালিত অটোবাইক নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। বরং ২০০৯ সালের ৭ জানুয়ারি এফএ ট্রেডার্স এর পক্ষ থেকে সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকায় চলাচলের অনুমতির জন্য আবেদন করা হয়। অনুমোদন ছাড়াই রিকশার নাম্বার প্লেট ব্যবহার করে সিলেটে অবাধে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এর ফলে যানজট যেমন বাড়ছে, তেমনি বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেড়ে চললেও এসব বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না সিলেট সিটি কর্পোরেশন কিংবা ট্রাফিক পুলিশ।

এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র ট্রাফিক বিভাগকে এইসব অটোবাইকগুলো পরীক্ষামূলকভাবে চলাচলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য লিখিতভাবে নির্দেশ প্রদান করেন। তখন ব্যাটারিচালিত অটোবাইক নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোন প্রকার ইস্যু করা কাগজপত্র ছিল না। দীর্ঘদিন এভাবে পেরিয়ে যাবার পর অটোবাইকের ১১৫ জন মালিক নাম্বার প্লেইট, ব্লু-বুক, লাইসেন্স প্রদানের জন্য ২০০৯ সালের ১৭ এপ্রিল মেয়র বরাবর আবেদন করেন। তাদের এই আবেদনের প্রেক্ষিতে অটোবাইকগুলোকে আইনের আওতায় এনে নাম্বার প্লেইট, ব্লু-বুকসহ লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দেয়ার আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এগুলোর যথাযথ ব্যবস্থা করে দেয়া হয়।
জানা যায়, ২০১১ সালের শেষ দিকে নতুনভাবে বের হয় ব্যাটারিচালিত রিক্সা। প্রথম অবস্থায় এইসব ব্যাটারিচালিত রিক্সাগুলো ঢাকা থেকে এনে নিজস্ব এবং বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে সিলেটে এগুলো বিক্রি করা হয়। পরবর্তীতে এইসব রিকশার চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এগুলো এখন নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় দেদারসে তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিদিন নতুনভাবে ব্যটারিচালিত রিক্সা তৈরি করার জন্য তাদের কাছে ৫-১০টি রিকশার অর্ডার আসে। কিন্তু তারা প্রতিদিন তৈরি করতে পারেন ৩-৪টি রিক্সা। এ কথাগুলো বলেন অটোরিক্সার মেকার মিলন।
রিক্সার কারখানাগুলোর সূত্রে জানা যায়, এইসব ব্যাটারিচালিত রিক্সার মধ্যে মোট চারটি ব্যাটারি রয়েছে। মূলত এইসব রিক্সা ব্যাটারি উপর নির্ভর করে চলে। প্রতিটি ব্যাটারি ১২ ভোল্টের। চারটি ব্যাটারির মোট ভোল্ট হলো ৪৮। এরমধ্যে ২ ধরনের ব্যাটারিচালিত রিক্সা রয়েছে। একটি পানিসহ ব্যাটারি যার মূল্য ৬০-৬৫ হাজার টাকা। অন্যটি হলো পানিছাড়া ব্যাটারি যার মূল্য ৫০-৫৫ হাজার টাকা। বর্তমানে সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকার ৩ হাজার ব্যাটারিচালিত রিক্সা রয়েছে। তাছাড়াও প্রতিদিন নতুনভাবে ৪০-৫০টি ব্যাটারিচালিত রিক্সা রাস্তায় নামছে। এইসব ব্যাটারিচালিত রিক্সার ৪৮ ভোল্টের ব্যাটারিগুলোকে প্রতিদিন ১০-১২ ঘন্টা চার্জ করতে হয়। প্রতিদিনের চার্জে রিক্সা ৮-১০ ঘন্টা রাস্তায় চলতে পারে। তাছাড়াও অনেকগুলো রিক্সা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রতিদিন ২-৩ বার চর্জ করতে হয়। প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিক্সা চার্জ করতে প্রতিদিন বিদ্যুতের খরচ হয় ৩ ইউনিট। ৩ হাজার ব্যাটারিচালিত রিক্সার চার্জ বাবদ বিদ্যুৎ খরচ হয় প্রতিদিন মোট ৯ হাজার ইউনিট। আর সপ্তাহ শেষে বিদ্যুতের খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ইউনিট এবং মাস শেষে গিয়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭০ হাজার ইউনিট। এত বিদ্যুৎ খরচ হলেও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই। নগরীর বিভিন্ন স্থানে এইসব ব্যাটারিচালিত রিক্সার ২০-৩০টি এজেন্ট রয়েছে এবং রিক্সা তৈরির কারখানা রয়েছে প্রায় ৩০-৪০টি।
সূত্রে জানা যায়, বাসা বাড়ীসহ বিভিন্ন কারখানা এবং অধিকাংশ দোকানগুলোতে একটি মাত্র বৈদ্যুতিক মিটারের মাধ্যমে কোনো প্রকার কিলোওয়াট না বাড়িয়ে দেদারসে ব্যাটারিচালিত রিক্সার চার্জ করা হচ্ছে। অন্যদিকে রিক্সাকে চার্জ করার জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান। আর সেইসব ব্যবসায়ীরা মিটার থেকে অতিরিক্ত লাইন ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক চার্জ দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। এক্ষেত্রে সরকারের অনেক বিদ্যুৎ অপচয় হলেও বিদ্যুৎ বিভাগ এইসব অসাধু ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে কোন প্রকার ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। বিদ্যুৎ বিভাগের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এ কাজের সাথে জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যে কারণে ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।  ব্যাটারিচালিত রিক্সার মালিকরা রিক্সার প্লেইট নাম্বার ব্যবহার করে প্রতিদিন ৩শত টাকা ভাড়া চুক্তিতে ড্রাইভারদেরকে দিয়ে চালাচ্ছেন। প্রতিদিন তারা ৩০-৪০টি ব্যাটারিচালিত রিক্সার মোটরসহ অন্যান্য মালামাল বিক্রি করছেন। এইসব ব্যাটারিচালিত রিক্সার কারণে একদিকে যেমন দিন নেই রাত নেই যখন তখন লোডশেডিং হচ্ছে, আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ। এ ব্যাপারে সিলেটের বিদ্যুত বিতরণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী এটিএম জহিরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, কোথাও অবৈধভাবে বিদ্যুৎ দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিক্সা চার্জ করা হলে এসব ব্যাপার আইন-শৃংখলা বাহিনী দেখবে। তাছাড়া কোন ব্যক্তি যদি তার মিটারের কিলোওয়াট না বাড়িয়ে ঐ মিটার থেকে চার্জ করে থাকে তাহলে এ ধরনের অভিযোগ পেলে আমরা বিদ্যুৎ আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমাদের যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে তা আমাদের চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত কম। তার উপর ব্যাটারিচালিত রিক্সার কারণে লোডশেডিং পর্যায়ক্রমে আরো বৃদ্ধি পাবে। যত দ্রুত সম্ভব এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, ব্যাটারিচালিত রিক্সাগুলোতে রিক্সার নাম্বার প্লেইট ব্যবহার করা হচ্ছে। তাছাড়ও এসব রিক্সার কাগহপত্রসহ চালকদের লাইসেন্স নেই। যার কারণে এগুলো জব্দ করার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে এবং আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, সরকার কর্তৃক এইসব ব্যাটারিচালিত রিক্সা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে নতুনভাবে আর কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশার অনুমতি দেয়া হবে না। তাছাড়াও ট্রাফিক বিভাগ এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দ করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

এসবিডি নিউজ ডেস্ক