নব চেতনায় উদীপ্ত হোক ১৪২৯

নব চেতনায় উদীপ্ত হোক ১৪২৯

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: বাঙ্গালী ঐতিহ্যের প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। ঋতুরাজ বসন্তের রেশ কাটতে না কাটতে-ই সকলের অপেক্ষা নতুন বছরকে ঘিরে। বৈশাখের প্রথম দিনটিকে বরণ করে নিতে প্রকৃতি যেন সাজে অপরূপ রূপে। সকলের-ই প্রাণে বেজে ওঠে এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…। আর প্রকৃতির সেই উজ্জ্বল রংকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই উন্মুখ। সকল পেশার প্রতিটি মানুষের মনে জেগে ওঠে বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের পরশ। সবাই নতুন বছরের শুরুর দিনটিকে অন্তত বাঙ্গালীর চেতনার তুলিতে অংকন করে ধরে রাখতে চেষ্টা করেন। ১৪২৯ সালের পহেলা বৈশাখের এই মহেন্দ্র ক্ষণে সকল পাঠকের প্রতি রইলো নববর্ষের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

বাংলা নববর্ষ শুরুর ইতিহাস নিয়ে রয়েছে নানান বির্তক। ইতিহাস বিশ্লেষনে জানা যায়, বাংলা নববর্ষের প্রর্বতন হয় মূলত ষোড়শ শতকে, মোগল সম্রাট আকবরের শাসনকালে। সম্রাটের নির্দেশে তাঁর বিজ্ঞ রাজ-জ্যোতিষী আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই প্রধানত বাংলা সালের উৎপত্তি। তিনি ‘হিজরী চান্দ’ বছরকে অত্যন্ত সুকৌশলে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সৌর বছরে রূপান্তরিত করেন। ফলে, হিজরী ৯৬৩ সাল থেকে বাংলা সালের জন্ম হয়।

বাংলা বছরকে এক সময় ফসলি অব্দ বলা হতো। বৈশাখের প্রথম প্রহর পালনের রেওয়াজ চালু হয় ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এই রেওয়াজ পালনের মূল প্রবক্তা সম্রাট আকবর। তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো বাংলামূলকের জনসাধারণের তথা কৃষিজীবীদের থেকে কর পরিপূর্ণ ভাবে আদায় করা। ঘরে নতুন ফসল এলে কৃষিজীবীদের পক্ষে রাজকর পরিশোধ করা সুবিধাজনক। কৃষকরা এদিন জমিদার-সামন্ত প্রভুদের কর প্রদান করতে এলে তারা খুশি হয়ে করদাতাদের কিছু দান-ধ্যান করতেন। ক্ষেত্রবিশেষ কর লাঘবও করে দিতেন। দিনটি রাজা-প্রজা উভয়ের কাছে-ই বেশ আনন্দ ও উৎসবের আমেজে পালিত হতো। সেই রেশ ধরে আজো পহেলা বৈশাখ বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের কাছে আলাদা ধরনের আবেদন রাখে। আবার এক সময় পহেলা বৈশাখকে ‘আমনি’ বলা হতো। আমনি শব্দের অর্থ অন্ন ও পানীয়। সহজ কথায় পান্তাভাত। চৈত্র সংক্রান্তির রাতে রান্না করা ভাত রাতের আহার শেষে বাদ-বাকি অংশে পানি দিয়ে তার ভেতর শাখা সমেত ছোট আম দিয়ে রাখা হতো। পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে সেই আমপাতা ভেজানো পানি ছিটিয়ে দেয়া হতো ঘরের উঠানে।

প্রাচীন প্রথা অবম্বনে মানুষের বিশ্বাস ছিলো এর ফলে অমঙ্গলের হাত থেকে রেহাই মিলবে। হয়তো সেই বিশ্বাসের ফলশ্রোতে পহেলা বৈশাখের প্রভাতে পান্তা ভাত দিয়ে প্রাতঃরাশের রেওয়াজ চলছে অদ্যাবধি। এরপর বহু শ্রোত গড়ালো পদ্মা-যমুনায়। এক পর্যায়ে ব্যবসায়ীরাও এগিয়ে এলেন পহেলা বৈশাখের আয়োজনে অংশ নিতে। নিয়মিত ক্রেতাদের বিশেষত যারা বাকিতে কেনা-কাটা করেন, তাদের নিমন্ত্রণ করে অয়োজন করা হতো উপাদেয় খানা-পিনার। বিদায়কালে আমন্ত্রিতরা তাদের সাধ্যমতো কর্জ চুকিয়ে দিতেন। যাদের ঋণ পরিশোধ হয়ে যেত তাদের নাম উঠতো নতুন খাতায়। চালু হলো হালখাতা পর্ব। জমিদারের কাল বিগত, পুণ্যাহের পর্ব প্রায় উঠে গেছে কিন্তু পহেলা বৈশাখের হালখাতার রেওয়াজ সারাদেশে-ই এখনো কমবেশি টিকে আছে।

পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে সমগ্র বাঙ্গালী জাতির প্রাণে জেগে ওঠে সাজসাজ রব। বলা হয়, বাংলার নারী লোকজ উৎসবের ধারক ও বাহক। পহেলা ফাল্গুনে বাংলার নারীরা হলুদ শাড়ি পরে বসন্তকে স্বাগত জানায়। অনেকটা একই ভাবে পহেলা বৈশাখে বাংলার তরুনীরা লাল-সাদা শাড়ি, হাতভর্বি লাল চুড়ি, কঁপালে টিপ দিয়ে এক অপরূপ মহিমায় বরণ করে নেয় বাংলা বছরের প্রথম দিনটিকে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদীপ্ত হয়ে যে কোন বয়সের ছেলে-মেয়ে এক হয়ে সৃষ্টি করে এক উৎসবমুখর আমেজের। জানা যায়, ১৩০৯ সালের পহেলা বৈশাখের প্রথমবারের মতো শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায় বৈশাখকে স্বাগত জানানোর ভিন্ন ধর্মী আয়োজনের সূচনা করেছিলেন কাবগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর সেই প্রেরণাকে পুঞ্জিভূত করে রমনার বটমূলে ১৯৬৭ সালে ছায়ানট আয়োজন করেছিলো পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রভাতি অনুষ্ঠান। ছায়ানটের সেই কার্যক্রম এখন অনেক বেশি প্রসারিত। এর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান অনুষঙ্গ সংযুক্ত হয়ে রমনায় আয়োজন করা হয় নানাবিধ অনুষ্ঠানের।

উৎসব মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের প্রকাশ। উৎসব কখনো একা একা হয় না, করা যায় না। সেটা একটা সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই ঘটে। আর তা মানুষের সম্মিলনের একটা উপলক্ষও বটে। যে মানুষরা উৎসব করে তারা একই ধরনের বিষয়ে আনন্দিত হয়, সাধারণ কিছু আচরণ, প্রথা তৈরি করে। তার মাধ্যমে একটা সাধারণ অভিজ্ঞতার ভাগাভাগি ঘটে। আর সম্প্রদায় বা জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এই সাধারণ অভিজ্ঞতার ভূমিকা বিপুল। পৃথিবীর বহু দেশেই একটা সাধারণ উৎসব হলো নববর্ষ। যা পুরনো বছরের হিসাব মেলানো আর নতুন বছরটা যাতে ভালো কাটে তার আশা-আকাংখার সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশে গ্রামেগঞ্জে এ উৎসব বহুকাল থেকেই পালিত হয়ে আসছে মেলা আর হালখাতা হিসেবে। পাহাড়ে এই উৎসবের নাম বৈসাবি। আর পুরো উৎসবের সঙ্গেই যেহেতু ভালো খাওয়া-দাওয়ার একটা সম্পর্ক থাকে, বৈশাখই বা তা থেকে বাদ যাবে কেন? হালখাতার সময় দই, মিষ্টি খাওয়ানোটা ছিল রেওয়াজ। বাড়িতে বাড়িতে হতো পায়েস, মাংস, মাছের বিশেষ পদ।

জানা যায়, রমনার অশ্বত্থতলায় ১৯৬৭ সালে ছায়ানটের বৈশাখী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা এবং পরবর্তীকালে এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা উল্লেখ করার মতো। ওই সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গণসংস্কৃতির প্রকাশ। ‘ক্রান্তি’ নামক গণসংস্কৃতি সংগঠনের জনপ্রিয় যাত্রাও বিশেষ ঘটনা। আর সত্তরের দশকে রমনার অশ্বত্থতলার আবেগ দ্রুতবেগে এগিয়ে চারুকলার বকুলতলায় গিয়ে ঠাঁই নেয়, যা রাজনৈতিক ভিন্ন বাঁকফেরা সত্ত্বেও বৈশাখী আবেগের প্রকাশে পিছু হটতে দেয়নি, এখনো হটেনি। পহেলা বৈশাখে ঢাকার রাজপথে মানুষের ঢল ও নানা চরিত্রের সংগঠনের উপস্থিতি তেমনই প্রমাণ দেয়।

ঐতিহ্যের সঙ্গে, পূর্বপুরুষের স্মৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক জোর করে নাই করে দেয়া যায় না, পাকিস্তানি শাসকরাও তা পারেনি। বাংলাদেশ হওয়ার পর এই উদ্যাপন ক্রমশ বিস্মৃত হয়েছে। চারুকলায় বর্ষবরণের শোভাযাত্রা একে নতুন রূপ দিয়েছে। কিন্তু একটা দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, যে গ্রাম এই উৎসবের সূতিকাগার সেখানে এই উৎসব ক্রমশ ক্ষীণ হতে হতে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতির রক্তশূন্যতা নিশ্চয়ই এর একটি বড় কারণ। অর্থাৎ যে জাতীয় বিকাশ আমাদের হচ্ছে সেখানে এই সংস্কৃতির উৎস গ্রামসমাজই বাদ পড়ে যাচ্ছে। এই অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পহেলা বৈশাখের সংগঠিত আয়োজন আমাদের মানুষের জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও এসে পড়ে!

জাতীয় সংস্কৃতি গড়তে হলে জাতীয় উৎসবের গুরুত্ব অপরীসীম। সেই উৎসবে গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই সমসত্ত্বতা না হোক সামঞ্জস্যতা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে গ্রামের ওপর সেটা চাপিয়ে দিলে চলবে না, বরং শাসক নগরকেই তার দায় নিতে হবে। আর সর্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে পহেলা বৈশাখের চেয়ে ভালো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। ঢাকার পহেলা বৈশাখ যদি গোটা দেশকে ধারণ করতে পারে কেবল তাহলেই তা জাতীয় সংস্কৃতি হয়ে উঠতে পারে।

বিভেদ-বৈষম্য মানুষের মধ্যের সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্থ করে। লোভ-ক্ষোভ- অভিমান মানুষের চিন্তা-চেতনাকে পঙ্গু করে দেয়। ১৪২৯ সাল নব চেতনায় উদীপ্ত হয়ে মানব প্রাণ করে তুলুক আলোকিত, করে তুলুক ভালোবাসাময়-সেটাই প্রত্যাশা। সর্বশেষে ১৪২৮ সালে সংস্কৃত অঙ্গন থেকে হারিয়ে যাওয়া সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। তাদের সৃজলশীল প্রেরণা আমাদের সকলের চলার পথের প্রদ্বীপ শিখা হোক সেটাই কামনা…!

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: সিনিয়র সাংবাদিক।।
প্রধান সম্পাদক, এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।
jsb.shuvo@gmail.com

 

প্রধান সম্পাদক