ঈদ: শান্তি ও সৌহার্দ্যের সম্পৃক্ততা

ঈদ: শান্তি ও  সৌহার্দ্যের সম্পৃক্ততা

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ:  মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর পালন করছে শোকাহত জাতি। বাঙালি মুসলিম জীবনে ঈদ উল ফিতর অন্যরকম একদিন। সবচেয়ে বড় আনন্দময় উৎসব জমে উঠে এই ঈদকে ঘিরেই। স্বভাবতই এই ঈদকে কেন্দ্র করে আয়োজনের ব্যাপ্তিও বেশি। ধনী দরিদ্র সবাই-ই ঈদ উল ফিতরকে উপভোগ করতে সাধ আর সাধ্যের সমন্বয়ে নানাবিধ প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। এই ঈদে মা, বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সবার জন্যেই নতুন পোশাক, জামা-জুতা কেনা বড় এক অনুসঙ্গ।

আনন্দঘন ও সৌহার্দ পরিবেশে সবাই ঈদুল ফিতর উদযাপন করে। যদিও এবার ঈদের চিরায়ত আনন্দে কিছুটা চিড় ধরেছে। রাজধানীসহ সারাদেশে যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসাহ উদ্দীপনায় ঈদ উদযাপনের সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ধর্ম মতে, ‘ফিতর’ মানে রোজা ভাঙা। ইফতার শব্দটিও ‘ফিতর’ থেকে এসেছে। ঈদুল ফিতর মানে রোজা ভাঙার ঈদ।

রমজানের দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনায় কষ্ট ও ক্লান্তির পর স্বাভাবিকভাবেই সুখ ভোগের বিষয়টি এসে যায়। ঈদুল ফিতর রোজাদারদের সেই স্বভাবসমেত সুখ উপহার দেয়। প্রত্যেকেই সাধ ও সাধ্যের মধ্যে জামা-কাপড়সহ পছন্দের জিনিসপত্র কিনতে চেষ্টা করেন। পবিত্র ঈদ মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করে এবং সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে। ধনী-গরীব ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিয়ে রাজা-প্রজা এক কাতারে শামিল করিয়ে দেয় পবিত্র ঈদ।

এই বছরের জুলাই মাসটি শুরু হয়েছে এক নৃশংস ঘটনার মধ্যে দিয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যুক্ত হয়েছে আরও এক কালো অধ্যায়ের। যে অধ্যায়টি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে আংকিত করছে। শংকিত পুরো জাতি। সার্বক্ষণিক এক অজানা ভয় তাড়া করছে। কী জানি, কখন কী হয়! এমন একটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতে পালিত হচ্ছে এবারের ঈদ।


৭ জুলাই (বৃহস্পতিবার) বাংলাদেশে উৎযাপন করা হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। শোকের মধ্যেই চলছে ঈদ উদযাপনের আয়োজন। ১ জুলাইয়ের গুলশানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় ঘটনা’র অদ্যাবধি কোন কূল-কিনারা নেই। সাম্প্রতিক সময়ে এটি-ই সম্ভবত শোকার্ত পরিবেশে পালন করা হচ্ছে ঈদ। যেখানে আনন্দের জায়গায় ভয়। উচ্ছাসের জায়গায় উৎকন্ঠা। এমন বিশ্রী রকমের এক অস্থির সময় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম। দেশের প্রধান ঈদের জামাত সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হবে। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ৫টি জামাত হবে। ঈদের জামাতে সবোর্চ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে প্রশাসন। তারপরও সাধারণ মানুষের কাটছে না শংকা। দূর হচ্ছে না আতংক।

রমজানের শুরুর দিনটি নগরবাসীর কেটেছে রোদ বৃষ্টির লুকোচুরিতে। সেই সাথে ছিলো চিরচেনা যানজট। এর পাশাপাশি নগরের বিভিন্ন এলাকায় চলা উন্নয়ন কাজ, আর সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি ভুগিয়েছে বেশ। সিয়াম সাধনার মাসে বিড়ম্বনাহীন জীবনের প্রত্যাশায় গুঁড়েবালি রাজধানীবাসীর। মৌচাকে এখন আর মধু মেলে না,মেলে শুধুই বিড়ম্বনা। ফ্লাইওভার আর রাস্তা সংস্কারের কারণে রাজধানীর অন্যতম এই পথে যাতায়াতকারীদের পোহাতে হচ্ছে অসহনীয় ভোগান্তি। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই! যন্ত্রনার মাত্রা ছাড়িয়ে যায় যেকোন সীমা।


বিগত দু বছরের বেশী সময় ধরে চলছে এমন চিত্র। মৌচাকের এই সড়কটিতে আছে বেশ কিছু বানিজ্যিক স্থাপনা ও বিপনীবিতান। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এমন অবস্থায় যেমন হচ্ছে ভোগান্তি, তেমনি কাজের ধীরগতি বাড়াচ্ছে দীর্ঘসূত্রীতা। অনেকটা একই চিত্র রাজধানীর কারওয়ানবাজার থেকে এফডিসি সড়কে। কাদা-পানি-আর যানজটে নাকাল। অপরিকল্পিত নগরায়ণ আর বিকল্প সড়কের অপ্রতুলতাকেই এমন ভোগান্তির কারন বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।


১ জুলাই যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটির কথা দেশ-বিদেশের মানুষ জেনেছে। প্রতি মুহুর্তে এই ঘটনায় যুক্ত হচ্ছে নতুনত্ব। বাড়ছে তর্ক-বির্তক। এমন একটা অবস্থায় সরকারের যেমন ভূমিকা গ্রহণ করা উচিৎ, সেটি তারা কতোটা করতে পেরেছেন বা পারছেন, সেই প্রসংগেও চলছে বাক-বিতন্ডা। চলছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা। সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের সুষ্ঠু কোন দিক নির্দেশনা নেই। ভয়-ভীতি দূর করার কোন উদ্যোগও নেই। ৫ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী’র প্রেস বিফিং মানুষের হতাশার জায়গা আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। সাংবাদিকদের কোন প্রশ্ন করার সুযোগ তারা দেননি, উত্তর দেয়ার ভয়ে। সুতরাং একথা ধরে নেয়া যায়, ভয় বা আতংক শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে নয়, সরকারের মধ্যেও রয়েছে। যারা আমাদের রক্ষা করবে তাদের অবস্থা এবং অবস্থান যখন নড়বড়ে তখন আর বিষয়টি নিয়ে আর বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। সার্বিক পরিস্থিতি কতোটা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে,সেটা সামান্য আঁচ করতে পারলেও বিশ্লেষণ করা দুরূহ।


এই ঈদে আত্মীয়স্বজনসহ প্রতিবেশী এবং গরিব-দুঃখী মানুষকে জামাকাপড় উপহার দেয়াসহ তাদের পাশে দাঁড়ানোটাও আমাদের ধর্মীয় চেতনার বড় অংশ। একই সাথে ঈদ উল ফিতরের দিনে প্রতিটি বাড়িতেই থাকে ভালো রান্নাবান্নার বাহারি রকমারি আয়োজন। প্রতিটি মানুষই এসব আয়োজন সবার সাথে ভাগ করে উপভোগ করে থাকেন। এই ঈদের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো-শহরের মানুষের শেকড়ে ফেরা এবং পরিবার পরিজনের সাথে মিলেমিশে ঈদআনন্দ উপভোগ করা।


প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ করতে কয়েক দিনে যারা নগরী ছেড়েছেন, তারা এখন গ্রামের বাড়ি পাড়া-পড়শির সঙ্গে কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত। আর নানা কারণে যারা ঢাকা ছাড়তে পারেনি, তারা ছুটেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিজ নিজ গন্তব্যে। গত কয়েক দিন ভিড় কিছুটা কম থাকলেও, ঈদযাত্রার একেবারে শেষ মুহূর্তে রাজধানীর বাস-লঞ্চ টর্মিনাল এবং রেলস্টেশনগুলোতে ঘরমুখী মানুষের ঢল দেখা গেছে।


পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান,বিভিন্ন পোশাক কারখানা ছুটি হওয়ায় গত ৪ জুলাই  হাজার হাজার শ্রমিক সড়কপথে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষ গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হওয়ায় এবং সারা দিনের বৃষ্টির কারণে দুপুরের পর সাভার, নবীনগর, চন্দ্রা, বাইপাইলসহ কয়েকটি মহাসড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সাভার, নবীনগর, চন্দ্রা, বাইপাইল এলাকায় অনেকে যানবাহন না পেয়ে হেঁটে সামনের দিকে এগোতে থাকে।


বৃষ্টিতে এ সময় ঘরমুখী এসব মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েন। সব বাস কাউন্টার, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, কমলাপুর, বিমানবন্দর রেলস্টেশনে দেখা যায় ঘরে ফেরা হাজার হাজার মানুষের ভিড়। অনেককে এ সময় বিভিন্ন বাস, ট্রেন এবং লঞ্চের ছাদে চড়তেও দেখা যায়। দেখা গেছে, ঘরমুখো মানুষের ঢল।


সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েক দিনে খুব একটা সমস্যা না হলেও,  দেশের উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গগামী বাসগুলো কিছুটা শিডিউল বিপর্যয়ে পড়ে। যাত্রীরা অভিযোগ করেন প্রায় প্রতিটি পরিবহনে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। বাস টার্মিনাল ছাড়া কমলাপুর রেলস্টেশনেও হাজার হাজার যাত্রীকে নিজ গন্তব্যে ছুটতে দেখা গেছে। অনেককে ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে চড়তে দেখা গেছে। তবে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের খুব একটা ভ্রুক্ষেপ ছিল না। এ ছাড়া ট্রেনের শিডিউলে বেশ কিছুটা বিপর্যয় ঘটে বলে জানা যায়।


সদরঘাটে প্রতিবারের মতো এবারো হাজার হাজার মানুষ ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চের ছাদে করে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হন। বাংলাদেশ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা থাকলেও অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে বাধ্য হয়ে লঞ্চগুলো ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছে বলে মালিকরা জানান। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে জানায়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তারা ব্যবস্থা নেবে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, এবারে প্রায় ১ কোটি মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঈদ উদযাপন করতে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে।


বাঙালি মুসলিম জীবনে ঈদ উৎসব উপভোগেও আমরা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। বিশ্বায়ন আর মিডিয়ার কারণে ঈদ উৎসব এখন আর সেই সনাতনি ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আর এ কারণে শুধু শহুরে জীবন নয়, গ্রামীণ জীবনের ঈদ উৎসবেও যুক্ত হয়েছে নানা পরিবর্তন আর বর্ণিলতা। তবে সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, গ্রামের ঈদ সবসময়ই বৈচিত্র্য ও বর্ণময়। সেই তুলনায় শহুরে ঈদ কিছুটা হলেও নাগরিক চরিত্রের মধ্যেই ডুবে থাকে।


গ্রামের ঈদে দারুণ প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। একসময় গ্রামে ঈদের দিন নামাজ শেষে নানা ধরনের খেলাধূলোর আয়োজন করা হতো যেখানে গ্রামের নবীন-প্রবীণ সবাই অংশ নিতো। রশি টানা, দৌড় প্রতিযোগিতা, নৌকাবাইচ, নবীন আর প্রবীণের মাঝে ফুটবল খেলা, ভলিবল খেলা, হাডুডু খেলা, লাঠি খেলা এরকম নানাবিধ খেলাধূলার আয়োজন থাকতো। একইসাথে থাকতো নাটক, পালাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বা বিচিত্র অনুষ্ঠানের আয়োজন। সেই ধারাবাহিকতায় এখনও আয়োজনের কোনো ঘাটতি নেই। তবে আগের তুলনায় আয়োজনে আরো বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার আয়োজনে আধুনিকতা যুক্ত হওয়ার কারণে পুরনো অনেক কিছুই আবার বিযুক্তও হয়েছে। ঈদের পুরনো সংস্কৃতির অনেক কিছুই মিঁইয়ে গেছে তথ্য প্রযুক্তির কারণে।


ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ বা উদযাপন। আর মোবারক শব্দের অর্থ কল্যাণময়। ঈদ হোক আনন্দময়। সকলের জন্যে। হিংসা-বিদ্বেষ, আত্ম অহংকারসহ সব অন্যায় ও পাপাচার মুছে দিয়ে নতুন করে সুখী পবিত্র জীবনযাপন শুরু করার প্রত্যাশায় সকলের প্রতি আমাদের রইলো ঈদ শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।।

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]

jsb.shuvo@gmail.com

 

প্রধান সম্পাদক