তনু হত্যাকাণ্ড: বিচারের আশায়,দিন যায়

তনু হত্যাকাণ্ড: বিচারের আশায়,দিন যায়

::শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ::

কয়েক মাস আগেও যে নামটি আমাদের অজানা, অপরিচিত ছিলো, সেই নামটি এখন জানেন না, এমন মানুষের সংখ্যা কম। অজানা নামটি আলোচনায় এসেছে একটি দুঘর্টনা মধ্যে দিয়ে। দুঘর্টনাটি পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, এই দুঘর্টনাটি কারা ঘটিয়েছে সেটি জানা। তাদের আইনের আওতায় আনা। শাস্তি’র ব্যবস্থা করা। দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এই প্রয়োজনীয় কাজটি করতে পারছেন না। ঘটনার ৯৪ দিন পেরিয়ে গেলেও, পুলিশ অদ্যাবধি ১ জনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশের এই অসাড়তা আমাদের মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিবেককে করছে দংশিত।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু। গত ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার একটি ঝোপের ভেতর থেকে কলেজছাত্রী তনুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ তনুর লাশ উদ্ধারের পর তদন্ত শুরু করলেও দ্বিতীয় দফায় এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ওপর। এরপর সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। সিআইডি তদন্তে প্রায় ৮০ দিন অতিবাহিত করেও এ পর্যন্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে আটক কিংবা তনুকে কারা ও কিভাবে হত্যা করেছে এর কোনো মোটিভ উদ্ঘাটন করতে পারেনি। এছাড়া দুটি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেই ফরেনসিক বিভাগ তার মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে না পারায় মামলার বিচার কার্যক্রম নিয়েই এখন শংকিত তনুর পরিবার।

তনুর লাশ উদ্ধারের পরদিন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে তার প্রথম ময়নাতদন্ত করেন ওই কলেজের প্রভাষক ডা. শারমিন সুলতানা। তিনি ৪ এপ্রিল ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে তনুর মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়নি এবং ধর্ষণের আলামতও পাওয়া যায়নি। আদালতের নির্দেশে ৩০ মার্চ দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্তের জন্য তনুর লাশ কবর থেকে উত্তোলন ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ময়নাতদন্তের জন্য গঠন করা হয় তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড। ১৪ মে কুমিল্লার আদালতে এসে পৌঁছায় নিহত তনুর সাতটি বিষয়ের ডিএনএ প্রতিবেদন। ১৬ মে তনুর ভেজাইনাল সোয়াবে তিন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়া যায়। তনুর ডিএনএ পরীক্ষায় আলামত পাওয়ায় প্রতিবেদনটি দেয়ার জন্য সিআইডিতে চিঠি পাঠান মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ডা. কেপি সাহা। একাধিকবার চিঠি চালাচালির পর আদালতের নির্দেশে ৭ জুন ফরেনসিক বিভাগের চাহিদা মোতাবেক তনুর ভেজাইনাল সোয়াব, দাঁত, চুল, অন্তর্বাস, কাপড়সহ ৭টি বিষয়ের ডিএনএ ফরেনসিক বিভাগে হস্তান্তর করে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। ১২ জুন ফরেনসিক বিভাগ ও দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত বোর্ডের প্রধান ডা. কেপি সাহা তনুর দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এতে তনুর মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া ওই প্রতিবেদনে মৃত্যুর আগে তনুর সঙ্গে ‘সেক্সচুয়াল ইন্টারকোর্স’ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তনুর এ প্রশ্নবিদ্ধ দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে সচেতন মহলে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তনুর পরিবারও প্রথম ময়নাতদন্তের ন্যায় দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে। ডিএনএ প্রতিবেদনে শুধু তিন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়ার প্রতিবেদন দিলেও দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে উত্তোলন করা পচাগলা মরদেহ থেকে কিভাবে তনুর সেক্সচুয়াল ইন্টারকোর্স মেডিকেল বোর্ডের কাছে ধরা পড়ল এ নিয়ে তনুর পরিবারসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুমিল্লার সিআইডির পরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম মিডিয়িকে জানান, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে যাই থাকুক না কেন ঘাতকদের চিহ্নিত করতে ডিএনএ সহায়তা নেয়া হবে,আমরা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন ও ঘাতক শনাক্তে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

তনুর বাবাকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তনুর মা আনোয়ারা বেগম। তনু হত্যার বিচার দাবিতে গত ২০ জুন কুমিল্লা মহানগরীর কান্দিরপাড় পুবালী চত্বরে আয়োজিত সমাবেশে তনুর মা এ অভিযোগ করেন। আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘মেয়ে হত্যার বিচার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার কারণে আমার স্বামী ইয়ার হোসেনকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যার চেষ্ঠা করা হয়েছে।’তিনি বলেন, ‘তনুর বাবাকে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না। আমরা তো সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলছি না। আমরা তনু হত্যার বিচার চাইছি।’তনুর মা অভিযোগ করে বলেন, ‘তনুর খুনিদের না ধরে আমাদের পাহারা দিয়ে রাখা হচ্ছে। বাসার ডিশ লাইন কেটে দেয়া হয়েছে যেন তনুর সংবাদ দেখতে না পারি।’

তনুর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ভুল উল্লেখ করে চিকিৎসকদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি। আনোয়ারা বেগম অভিযোগ করেন, ‘চিকিৎসকদের সঙ্গে ঘাতকদের আঁতাত থাকায় ভুল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে।’তনুর ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ না থাকার বিষয়ে তার মা বলেন, ‘তনুর লাশ শিয়াল-কুকুরে খেলে তখন বলতো শিয়ালে মেরেছে। তনুর যদি স্ট্রোক হতো তাহলে তার লাশ রাস্তার পাশে পড়ে থাকতো, জঙ্গলে পড়ে থাকতো না। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকতো না।’তনুর বাবাকে হত্যার চেষ্টা করা প্রসঙ্গ তুলে ধরে আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘গত ২৬ মে সিআইডির কর্মকর্তারা যখন একটি সংস্থার কার্যালয়ে তনুর লাশ পাওয়ার সময় আলামত সংগ্রহকারী তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সে দিন রাত ৮টার দিকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডে ডিউটি শেষ করে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বাসায় ফিরছিলেন। তিনি তনুর লাশ পাওয়ার স্থান দিয়ে আসার সময় একটি বাস প্রচণ্ড গতিতে এসে তাকে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করে।’তিনি বলেন,’তনুর বাবা দ্রুত রাস্তার পাশে গিয়ে রক্ষা পান। এর কিছুক্ষণ পর দুইজন আরোহীর একটি মোটরসাইকেল তনুর বাবাকে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় তিনি রাস্তার পাশে খাদে পড়ে রক্ষা পান।’

তনু’র মায়ে অভিযোগের ব্যাখ্যা আমাদের কাছে কাছে। কিন্তু এর সদুত্তর নেই প্রশাসন কাছে। এই ঘটনার সাথে যে প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশ রয়েছে, সেটা বুঝতে বুদ্ধিজীবী হতে হয় না। পত্রিকান্তরে আমরা জেনেছি, সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে একটি গোয়েন্দা দল। কিন্তু তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে তাদের রহস্যজনক নীরবতার কারণ অজ্ঞাত। একই বৃত্তে ঘুরছে চাঞ্চল্যকর তনু হত্যামামলার তদন্ত। লেফটেন্যান্ট শেখ পারভেজ আহমেদের পুত্র পেয়ার আহমেদ অনারারি’র দিকে প্রাথমিক দিকে সন্দেহের তীর থাকলেও, সেটা রহস্যজনকভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট। ‘তনু হত্যার ঘটনা দেশের জনগণকে বিচলিত করেছে। জনগণ এর সুষ্ঠু বিচার চায়’। গত ১৭ মে একথা মিডিয়ার সামনে পরিস্কারভাবে বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের তথ্যানুযায়ী,গত এক বছরে ১৫৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩১ নারীকে। অপরদিকে, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য বলছে, ২০১৫ সালের শুধু ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৬৩টি। জানুয়ারিতে ৫৫টি। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিন হাজার ৯২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন পত্রিকা, মামলা ও অভিযোগের ভিত্তিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে নিবন্ধিত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার ৪৫৫ জন। এদের মধ্যে শিশু ১৩৫ জন।  ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ১১ জন। নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে সরকারের মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে ধর্ষণসহ যত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মামলা হয়নি। বিচারের হার এক শতাংশেরও কম।

এমন এক উদ্বেজজনক পরিস্থিতে তনু নামের এক তরুণীর বিচারের দাবী উঠেছে। বর্তমান যুগ প্রযুক্তির। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের খবর অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া মুহুর্তের ব্যাপার। সারা বিশ্ব বাসী জেনেছে, বাংলাদেশে সোহাগী জাহান তনু’র নাম। তার সাথে ঘটে যাওয়া বর্বরতা এবং প্রশাসনের অসাড়তা। আমরা দেখেছি, তনু’র মায়ের আহাজারি। দু’হাত তুলে অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি তার কন্যার হত্যার বিচার চাইছেন। প্রতিদিন ভালো কোন খবরের আশায় থাকছেন। যেমনটি থাকছেন, এহেন লাঞ্ছনার শিকার হাজারও মা। তাদের কান্না আমরা শুনি। আমরা দেখি। পত্র-পত্রিকায় লিখি। প্রতিবাদ জানাই। কিন্তু বিচার পাই না। বিচার না হওয়া-টা যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ফলে অপরাধ ক্রমশ বাড়ছে।

গত ১৯ জুন বিকেলে তনুর মা আনোয়ারা বেগম স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, তনু হত্যার পর ন্যায়বিচারের জন্য অনেকেই তো শান্তনা ও আশ্বাস দিয়েছিলেন কিন্তু এখন তো কোথাও ভরসা পাচ্ছি না। কার কাছে বিচার চাইব? তিন মাসেও একজন ব্যক্তিকেও তো এ মামলায় গ্রেফতার করা হল না। বারবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদলানো হল। অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল কিন্তু মামলার ফলাফল কি আমরা এখনও জানি না।

সত্যিই তো কার কাছে বিচার চাইবেন তনু’র মা। যাবতীয় আশ্বাসের বিশ্বাসেও এখন গুঁড়েবালি। তার স্বামীর প্রাণ সংশয়। কি অপরাধ এই পরিবারের? কোন পাপে পরিবারটি’র আজ এমন বেহাল দশা? এমন বেহাল দশায় থাকা পরিবার গুলো’র খোঁজ রাখেন ক’জন? তবুও তনু’র বিষয়টি ৯৪ দিন ধরে মিডিয়ায় ঠাঁই পেয়েছে। এক সময় সেটাও শ্লথ হয়ে যাবে। গত ২২ জুন তনু হত্যা মামলার অগ্রগতির প্রসঙ্গে  কুমিল্লার বিশেষ পুলিশ সুপার (সিআইডি) ড.নাজমুল করিম খান বলেন, ‘দীর্ঘদিন পরে বঙ্গবন্ধু হত্যা,চার নেতা হত্যা,মানবতাবিরোধী হত্যার বিচার হয়েছে। একটু সময় লাগলেও তনু হত্যার বিচারও হবে। তদন্ত চলছে’।

কুমিল্লার বিশেষ পুলিশ সুপার (সিআইডি) ড.নাজমুল করিম খান যে বিচারের উদাহরণ টেনেছেন সেই বিচার পেতে জাতিকে ৪৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। তারপরও সেই বিচার প্রক্রিয়া সর্ম্পকে আমরা কম-বেশী অবগত। কিন্তু ঐ বিচারের সাথে এই বিচারের সাদৃশ্য বুঝতে আমরা সক্ষম নই। আমরা জানি তদন্ত চলছে। এমন বহু তদন্ত যুগের পর যুগ চলমান রয়েছে। আলোর মুখ দেখে না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। তবুও আমরা আশা করতে চাই। আমরা দেখতে চাই তনু’র হত্যাকারীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি। অন্তত একটি সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে হয়তো ভবিষ্যত বিচার প্রকৃয়ার গতি আসবে। আমরা আশায় আছি। অধির আশা। এই আশা যেন হতাশায় পরিণত না হয়, সেটাই প্রত্যাশা।।

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ:  প্রধান প্রতিবেদক, এসবিডি নিউজ24 ডট কম]

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক