শ্রদ্ধার্ঘ্য

শ্রদ্ধার্ঘ্য

সৈকত রুশদী: শহীদ জায়া, এক সংগ্রামী ও সফল বাঙালি নারী। পরম শ্রদ্ধা জানাই এই শহীদ জায়াকে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের বিধবা স্ত্রী ও সন্তানেরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে কোথাও তা’ লেখা নেই। অগত্যা আয়েশা ফয়েজকে নিজেকেই লিপিবদ্ধ করতে হয়েছে নিজের কথা।

তাঁকে জীবনে একবারই দেখেছি। গত এপ্রিলে। আমার মায়ের চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের লিখিত রিপোর্টের জন্য জন্য ধানমন্ডি ল্যাবএইডে যখন অপেক্ষা করছিলাম কর্তব্যরত চিকিৎসকের সামনে, তখন চিকিৎসা শেষে তাঁকে হুইল চেয়ারে ঠেলে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন কনিষ্ঠ পুত্র আহসান হাবীব।

খুব কাছে থেকে দেখেছি স্বাধীনতার আগেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখানো উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’-এর স্রষ্টা শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশার স্ত্রী ও সন্তানদের। শহীদ অধ্যাপক রাশিদুল হাসানের কন্যা সহপাঠিনী সঙ্গীত শিল্পী রোকাইয়া হাসিনাকে। শহীদ মুনীর চৌধুরীর সন্তানদের, ব্যাচমেট মিশুক মুনীরকে। যে স্ত্রী শহীদ স্বামীর মরদেহটি খুঁজে পাননি, যে সন্তান শহীদ পিতার দেহাবশেষ ছুঁয়ে দেখতে পারেনি, তাঁদের যে অব্যক্ত বেদনা, তা’ আর কারও পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। বিধবা স্ত্রীদের অনেকে দীর্ঘ রাত জেগে অপেক্ষায় থাকেন, যদি ফিরে আসে! নির্ঘুম কাটে রাতের পর রাত। দিনের পর দিন। তেতাল্লিশ বছর। সন্তানদের অনেকের অবস্থাও একই। আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়, নানা আনোয়ার পাশা। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ঘুমের ওষুধ ছাড়া কোন রাত স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পেরেছেন কীনা জানিনা। কী দু:সহ যাতনা প্রতিনিয়ত তাঁদের যেভাবে কুরে কুরে খায়, আমরা কজন তার খবর রাখি! বাংলাদেশের কতজন মানুষ তাঁদের সম্পর্কে জানতে পেরেছে, বা চেয়েছে!

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি ও রাজনীতিতে এইসব মানুষের কথা অগ্রাধিকার তো দূরের কথা, সামান্যতম স্থান পায় কী? পেয়ে থাকলে মুক্তিযুদ্ধে স্বামী হারানো, প্রথম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তার বিধবা স্ত্রী আয়েশা ফয়েজকে স্বাধীনতার অল্পদিন পরই সরকারের বরাদ্দ করা বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে আক্ষরিক অর্থেই পথে বসানো হতোনা। শহীদ পরিবার উচ্ছেদ করে সেই বাড়িতে কোন স্বাধীনতা বিরোধী বা রাজাকার নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক নেতার আবাসনের ব্যবস্থা করা হতোনা। আমদের চোখ কেবল দেখতে পায় কী ঘটেছে। কী হয়েছে। আমরা স্মৃতিতে ভরে রাখি সেইসব বেদনার কথা।

শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা হলে লজ্জাবনত হই। কতোকিছু করার ছিল তাঁদের জন্য। আমরা তাঁদের থেকে নিয়েছি। কেড়ে নিয়েছি পরিবারের প্রধান, আমার মামীর বাবা ভেড়ামারা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার শহীদ ইলিয়াস মল্লিক অথবা আমার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের অগ্রজতুল্য ছাত্র শহীদ শফি ইমাম রুমি’র মতো আদরের সন্তানটিকে। কিন্তু প্রতিদানে সেইসব পরিবারের জন্য কী করেছি আমরা! পরিবারকে বড় জোর একটি বাসগৃহ সাময়িক বরাদ্দ এবং/অথবা কোটার ভিত্তিতে একটি বা দুটি সন্তানকে চাকুরী জুটিয়ে দেওয়া ছাড়া রাষ্ট্র আর কী করেছে? সকলের জন্য নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ কিংবা প্রাপ্য সম্মানটুকু কী দিয়েছে!

গুণী ও সফল লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও জাফর ইকবাল এবং সম্পাদক আহসান হাবীবের মা হিসেবে আয়েশা ফয়েজ পরবর্তীকালে যে পরিচিতি ও সম্মান পেয়েছেন বা অর্জন করেছেন, সেটি আর কোন শহীদ জায়া পাননি। এইসব অপমান তুচ্ছ করে জীবন যুদ্ধে যিনি বিজয়িনী হয়েছেন, যাতনাবিদ্ধ শহীদ পরিবারের এক সাহসী প্রতিনিধি, সেই প্রতিবাদী আয়েশা ফয়েজ আজ সব যাতনার উর্ধ্বে। তাঁর বিদেহী আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক অনন্তকাল ধরে।

[লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক।]
টরন্টো,কানাডা।
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

অতিথি লেখক