নানবিধ মন্তব্য ও বাস্তবতা

নানবিধ মন্তব্য ও বাস্তবতা

খুরশীদ শাম্মী: সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস মুহাম্মদের একটা মন্তব্য খুব করে প্রচার হচ্ছে, ‘বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের যুদ্ধ প্রস্তুতি না নেওয়াটা আত্মঘাতী।’ প্রধান উপদেষ্টার এই মন্তব্যের কারণ হিসেবে বর্তমান বিশ্বে চারদিকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধের হুমকি এবং ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। হ্যাঁ, ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের সম্ভাবনা অবশ্যই তার মন্তব্যের একটা কারণ হতে পারে। তবে, বিষয়টি আরো একটু তলিয়ে দেখলে চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও ভয়াবহ।

প্রধমত, আগস্টের পাঁচ তারিখের পর প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে বেশ কয়েকবার বলেছে, আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি। তার ওই বক্তব্য প্রমাণ করে যে তখনও যুদ্ধ চলছিল। মূলত তার ভেতরে একটা শঙ্কা কাজ করত যে ষড়যন্ত্র দ্বারা অর্জিত তার/তাদের ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পূর্বে যেকোনো মূহুর্তে বিলীন হয়ে যেতে পারে। সুতরাং সে তার ষড়যন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে মূল উদ্দেশ্য যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছে সেই প্রথম থেকেই।

দ্বিতীয়ত, ২০২৪ সালের আগস্টের সেই পাঁচ তারিখ থেকে মুহাম্মদ ইউনূসের অনুসারী লাল বাহিনী ভারতের সেভেন সিস্টার খেয়ে দেওয়ার কথা বলে আসছিল। কেউ কেউ তো মাত্র চারদিনে উত্তর পূর্ব ভারত দখল করে নতুন সীমান্ত তৈরির হুমকিও দিয়েছিল। তবে, চীন সফরকালে স্বয়ং ইউনুস মুহাম্মদের মন্তব্য ছিল মারাত্মক। সে বলেছিল, ‘ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সাতটি রাজ্য, যাকে সাত বোন রাজ্য বলা হয়, সম্পূর্ণরূপে সেগুলি স্থলবেষ্টিত। তাদের সমুদ্রে পৌঁছনোর কোন উপায় নেই। আমরা (বাংলাদেশ) সমগ্র অঞ্চলের (উত্তর-পূর্ব ভারত) সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক।‘ শুধু এখানেই শেষ নয়, চীনা অর্থনীতির সম্প্রসারণের সুযোগ হিসেবে উত্তর পূর্ব ভারতকে দেখা উচিত বলেও মন্তব্য করেছিল সে। তার সেই মন্তব্য ভারতে বেশ সমালোচিতও হয়েছিল। – গত নয় মাসে ক্রমাগত চলতে থাকা এগুলো সবই ছিল ভারতের সাথে যুদ্ধ বাঁধানোর জন্য উস্কানিমূলক মন্তব্য ছোড়া।

তৃতীয়ত, ২০২৪ সালে আগস্টের আট তারিখ শপথ পাঠের পর প্রথম যে কাজটি প্রধান উপদেষ্টা করেছে, তা হচ্ছে পাকিস্তানের সাথে তাদের ভাই-ভাই সম্পর্ককে প্রকাশ্যে আনার নাটক। পরস্পর আস্থা প্রতিস্থাপন ও পীঠ চুলকাতে পাকিস্তানের একাধিক জাহাজ ভরে পণ্য আমদানি করল দ্রুত। যেহেতু বিশেষ পরিস্থিতিতে জাহাজের মালামাল খালাস করা হয়েছে, সুতরাং ধারণা করা যায়, জাহাজে সাধারণ ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি অন্যান্য রাসায়নিক ও সামরিক অস্ত্র সরঞ্জাম আমদানি করা হয়েছে। হ্যাঁ, হঠাৎ করে ঘনঘন দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দুই দেশ সফর ও আলোচনায় বসা অবশ্যই পূর্বের বাক্যটি সমর্থন করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামর-উল-হাসানের পাকিস্তান সফরকে পাকিস্তান ঐতিহাসিক ঐক্যের সূত্রপাত হিসেবে দেখছে। এরপরেও, যুদ্ধ প্রস্তুতির সূত্রপাত যে দীর্ঘদিন আগে থেকেই করা হয়েছে, তা অস্বীকার করার অবকাশ থাকে কি?

চতুর্থত, আগস্ট মাসে অসাংবিধানিক প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর সর্বপ্রথম যে কাজটি উপদেষ্টামণ্ডলী করেছে, তা হলো বিশেষ আইন প্রয়োগ করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বাংলাদেশিদের যাতায়াত প্রথমে কমিয়ে দেওয়া ও পরবর্তীতে তা বন্ধ করে দেওয়া। এটাই মূলত জনগণের অধিকার খর্ব করে মাঠপর্যায়ে যুদ্ধ প্রস্তুতির অন্যতম ধাপ ছিল। পরবর্তীতে, পরপর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্যাসিফিকের ডেপুটি কমান্ডিং জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল জোয়েল পি ভাওয়েলের বাংলাদেশে সফর অবশ্যই যুদ্ধ প্রস্তুতির মাঠপর্যায়ের আরো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা যায়।

পঞ্চমত, নিজ দেশের মানুষকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়ে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশ হয়ে জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে ‘মানবিক করিডোর’ দিতে বর্তমান অসাংবিধানিক সরকার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে আইনগতভাবে তারা এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাখে না। এরপরও, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত তারা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা না করে একক সিদ্ধান্তে নিয়েছে। এ নিয়ে দেশে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে, রাজনৈতিক দল থেকে বিরোধিতা করা হচ্ছে। অথচ প্রধান উপদেষ্টা ও তার পক্ষ মিথ্যা মানবতার নামে ষড়যন্ত্রের মূল লক্ষ্যের উদ্দেশ্য চলছে তো চলছেই। কোনোভাবেই তাদের গতিরোধ করা যাচ্ছে না।

শুধু এই পাঁচটি নয়, এমন আরো অনেক প্রমাণ পাওয়া যাবে। এক কথায় চরম বাস্তবতা হচ্ছে, যুদ্ধটা তাদের মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ ব্যতীত অন্য কিছু নয়।

[লেখক: খুরশীদ শাম্মী।]

অতিথি লেখক