স্যরি বেনজির ভাই…

স্যরি বেনজির ভাই…

প্রভাষ আমিন: সকালে ঘুম থেকেই উঠেই খুব প্রিয় একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানলাম দুঃসংবাদটি। সেই প্রিয়জনের নাম উল্লেখ করতে পারছি না, কারণ আমার কোনো লেখায় তার নাম উল্লেখ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। ভোরের কাগজের সাবেক সম্পাদক বেনজির আহমেদের মৃত্যুসংবাদ সকালেই মনটা খারাপ করে দিলো। আকাশ ভেঙে নামা বৃষ্টি আমাকেও কাঁদিয়ে গেল। এক ধাক্কায় চলে গেলাম ১৯ বছর আগে। ’৯৫ সালে আমি যখন ভোরের কাগজে যোগ দেই, তখন বেনজির ভাই ছিলেন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। বাংলামোটরের অফিসের দোতলার কোনার একটি রুমে বসতেন। সত্যি কথা বলতে কী, শুরুর দিকে আমরা রিপোর্টাররা বেনজির ভাইকে একটু অপছন্দই করতাম। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে আমাদের সব বিল পাশ হতো তাঁর হাত দিয়ে। তিনি সব বিলই কিছু না কিছু কমাতেন, তাতেই আমরা বিরক্ত হতাম। এখন বুঝি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদককে সবসময় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হতো। পরে যখন মতি ভাই (সম্পাদক মতিউর রহমান) ভোরের কাগজ ভাঙার চেষ্টায় একটা বড় গ্রুপ নিয়ে প্রথম আলো করতে চলে গেলেন, তখন কাগজের হাল ধরেন বেনজির ভাই। অনেকেই চলে গেছেন, চারদিকে নানা ষড়যন্ত্র; তবুও বেনজির ভাইয়ের নেতৃত্বে ঠিক পথেই ছিল ভোরের কাগজ। অনেকে চলে গেলেও আমরা অনেকে থেকেও গিয়েছিলাম। অমিতদা (অমিত হাবিব), পুলকদা (পুলক গুপ্ত), অলকদা (সুকান্ত গুপ্ত অলক), শ্যামলদা (শ্যামল দত্ত), দীপু ভাই (মোস্তফা ফিরোজ), আমিন ভাই (আমিনুর রশীদ), মামুন (জ. ই. মামুন), মুন্নী (মুন্নী সাহা), পিন্টু (জায়েদুল আহসান), পাখা (পারভেজ খান), রঞ্জনা আপা (শাহানা হুদা)সহ অনেকেই তখন ভোরের কাগজের জন্য জীবনপণ। স্পোর্টসের হাল ধরার জন্য কানাডা থেকে ছুটে আসেন টিটো ভাই (ফরহাদ টিটো)। সাহিত্যের হাল ধরেন সাবের ভাই (মঈনুল আহসান সাবের)। ফিচারে ওয়ান অ্যান্ড অনলি সঞ্জীবদা (সঞ্জীব চৌধুরী) তো ছিলেনই, তার সাথে ক্রাইম রিপোর্টিং ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন তাপস (কাজী নাজমুল আলম)। তখন ভোরের কাগজের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধির দায়িত্ব নিয়েছিলেন পরে বিকেএমইর সভাপতির দায়িত্ব পালন করা ফজলু ভাই (ফজলুর রহমান)। তখন আসলে আমাদের কাজের আলাদা ক্ষেত্র ছিল না। ডেস্ক, রিপোর্টিং, স্পোর্টস, ফিচার, সাময়িকী- সব মিলে মিশে ভোরের কাগজ পরিবার। আর সেই পরিবারের কর্তা ছিলেন –স্নেহশীল বেনজির আহমেদ। রঞ্জনা আপার দিলখোলা অট্টহাসিতে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠতো ভোরের কাগজ ভবন। কেউ অবিশ্বাসে হাসবেন না। রঞ্জনা আপার হাসিতে যে ভবন কেঁপে উঠতেই পারে, প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া কারো পক্ষে এটা বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন।
এ পর্বেই আমরা অন্যরকমভাবে চিনলাম বেনজির ভাইকে। এত ভালো মানুষ হয় নাকি! মতি ভাইয়ের সাথে যাইনি বলে ভোরের কাগজে তখন আমাদের এক ধরনের দাবি ছিল। সেই দাবিতে বেনজির ভাইকে কত যে জ্বালিয়েছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। স্নেহের দাবি কখনো কখনো ব্ল্যাকমেইলের পর্যায়ে নিয়ে যেতাম। খিদা লাগছে, খাওয়ান; পার্টি করবো, টাকা দেন; এটা না দিলে ওটা করবো না- এমন হাজার আবদার, অত্যাচার। বেনজির ভাই সব মেনে নিতেন হাসিমুখে। আমাদের সম্মিলিত অত্যাচারে বেনজির ভাই কিছুটা অসহায় ছিলেন। কিন্তু এই এত বছর পরও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, বেনজির ভাইয়ের অসহায়ত্বকে আমরা কখনো অপব্যবহার করিনি। মতি ভাইয়ের সময়ে অফিসে যতটা সময় দিতাম, বেনজির ভাইয়ের সময় দিয়েছি তার কমপক্ষে দ্বিগুণ। দিন নেই, রাত নেই; কাজ আর কাজ। দিনে রিপোর্টিং, রাতে স্পোর্টস- সব ধরনের কাজই করেছি। কারণ চ্যালেঞ্জটা শুধু বেনজির ভাইয়ের ছিল না, ছিল আমাদের সবার ক্যারিয়ারের চ্যালেঞ্জ। মালিকপক্ষের একটু সহায়তা পেলে সেই চ্যালেঞ্জে আমরা ভালোমতোই জিততে পারতাম। কিন্তু ভোরের কাগজের সার্কুলেশন যখন বাড়ছিল, তখনই রাশ টেনে ধরেন মালিকপক্ষ। চাহিদার চেয়ে অনেক কম ছাপা হতো। এভাবেই নিশ্চিত সম্ভাবনাকে সম্ভব না’য় বদলে দিলেন মালিকপক্ষ। আস্তে আস্তে ভেঙে গেল আমাদের ভোরের কাগজ পরিবার। বৃহত্তর ভোরের কাগজ পরিবারের অনেকেই এখন বাংলাদেশের গণমাধ্যমের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে রয়েছেন।
ভোরের কাগজ ছাড়ার পর দুয়েকবার এখানে সেখানে বেনজির ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলেও, আমাদের জগত থেকে অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছিলেন চিরকুমার বেনজির ভাই। এবার একেবারেই হারিয়ে গেলেন। আমরাই খোঁজ রাখিনি। স্যরি বেনজির ভাই, আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি, তবে অনেক ভালোও বেসেছি। জ্বালাটা দেখেছেন, আশা করি ভালোবাসাটাও টের পেয়েছেন।
মানুষ মরে গেলে, আমরা সবাই সত্য হোক, মিথ্যা হোক বলি, বড় ভালো লোক ছিলেন। কিন্তু সত্যি করেই বলছি, বেনজির ভাইয়ের মতো সরল, সৎ, রুচিশীল, ভালো মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি। বিশ্বাস করুন, অনেক খুঁজেও, অনেক ভেবেও বেনজির ভাইয়ের বিরুদ্ধে বলার মতো একটি কথাও পেলাম না। মরার পর মানুষ কোথায় যায় জানি না। যেখানেই থাকেন, ভালো থাইকেন বেনজির ভাই।

[প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক।।]

probhash2000@gmail.com
৩ জুন, ২০১৪

অতিথি লেখক