এক পায়ে নূপুর আমার…

এক পায়ে নূপুর আমার…

প্রভাষ আমিনঃ
বুধবার দিনটি শুরু হয়েছে সাভারে রানা প্লাজা নামের ৯ তলা ভবন ধসের খবর দিয়ে। দ্রুত টেলিফোনে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে ছুটে যাই অফিসে। তারপর সারাদিন শুধু রোবটের মতো লাশ গুনে যাওয়া- ১৫, ২৫, ৪২, ৫৫, ৬৪, ৭৫, ৯২, ৯৮, ১০২- এভাবেই বাড়তে থাকে সংখ্যা। এখনো জানি না কোথায় গিয়ে থামবে এই লাশের মিছিল। ক্ষোভে, দুঃখে, লজ্জায়, অপমানে, অধিক শোকে আসলে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। সাংবাদিকতা আমার খুব প্রিয় পেশা। কিন্তু মাঝে মাঝে ঘেন্না ধরে যায়। তৃতীয় বিশ্বের এই দেশে সাংবাদিকতা করি বলেই এইভাবে দিনের পর দিন আমাদের কেরানির মতো লাশ গুনে যেতে হবে। গভীর রাতে বাসায় ফিরি ক্লান্তি আর অবসাদ নিয়ে। রাত কাটে টেলিফোনে যোগাযোগ আর টিভি পর্দায় চোখ রেখে। সকালে দ্রুত অফিসে যাওয়ার তাড়া। দাঁত ব্রাশ, গোসল, নাস্তা- সব স্বাভাবিক, নিখুঁত পেশাদার। আসলে পুরোটাই মানসিক বৈকল্য ঠেকানোর চেষ্টা, কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য এক ধরনের প্রতিরোধ।

আমার সব প্রতিরোধ ভেঙে দিল একটি পা, একটি ছবি। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল আপ করেছে নিষ্ঠুর এই ছবিটি। সাভারের ধসে পড়া ভবনের দুই স্ল্যাবে চাপা পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া এক নারীর পা, শুধু একটি পায়ের পাতা গোড়ালিসহ দেখা যাচ্ছে। সেখানে ঝুলছে একটি নূপুর। একপায়ে নূপুর আমার…। আহারে বোন আমার! হয়তো নূপুর খুব ভালোবাসতো। নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক…। হয়তো তার নয়, তার প্রিয়জনের পছন্দ ছিল আলতা পায়ে নূপুর পরা। হয়তো বিয়েই হয়নি বা হয়েছে। হয়তো বাবার খুব প্রিয় ছিল। ছোটবেলা থেকেই চাইতেন মেয়ে তার নূপুর পায়ে ঝুমুর ঝুমুর ছন্দ তুলে হেঁটে বেড়াবে। হয়তো আমার এই শ্রমজীবী বোনটির পায়ে আলতার আলতো ছোঁয়াও ছিল। ধুলাবালিতে ঢাকা পড়ে গেছে তা। না, একটু যেন লালচে আভা দেখলাম পায়ে। জানি না তা আলতা না রক্ত। জীবন আর মৃত্যু এখানে একাকার, আলতা আর রক্ত আলাদা করে চেনা যায় না। কত অল্পে সন্তুষ্ট আমাদের দেশের এই মানুষগুলো। হয়তো এই নূপুর কিনতে তাকে ওভারটাইম করে টাকা জমাতে হয়েছে, প্রতিদিনের বাজার খরচ থেকে টাকা বাঁচাতে হয়েছে। অতটুকু চায়নি বালিকা, চেয়েছিল আরো কিছু কম। আমার বোনটির সেই একটি পা যেন কষে লাথি মারছিল গার্মেন্টসের লোভী মালিকদের চকচকে মুখে, মাস্তান ভবন মালিকের নিষ্ঠুর চোখে, আমাদের নিরাপদ জীবনযাপনের আতিশয্যে, সাংবাদিকতার নামে আমাদের নিষ্ঠুরতার দেয়ালে।

সারি সারি লাশ আমাদের কাছে ছিল নিছক পরিসংখ্যান। কিন্তু আমার আদুরে বোনটির এক পায়ের নূপুর ভেঙে দিয়েছে আমার প্রতিরোধের সব দেয়াল, পেশাদারিত্বের কাচের ঘর, পাথর গলে জল হয়ে গেছে। দু ফোটা কি গড়িয়ে পড়লো চোখ বেয়ে? মনে পড়ে গেল হুমায়ুন আজাদকে- “আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো, ছোট ঘাসফুলের জন্য, একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্য…, ঝুলতে থাকা একটি নূপুরের জন্য।”
সারি সারি লাশ যা পারেনি, তাই পেরেছে একটি নূপুর। শুধু নাম না জানা এই বোনটির গল্প নয়, সাভারের রানা প্লাজার সামনে এখন এমন শত শত বিষাদ সিন্ধুর স্ক্রিপ্ট। মাকে ফোন করে বাঁচানোর আকুতি জানাতে জানাতে একসময় বুজে আসে ছেলের কণ্ঠ। একসময় ফোনের চার্জ ফুরিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় ছেলেটির জীবনের চার্জও। মায়ের জন্য সন্তানের অপেক্ষা, স্বামীর ছবি নিয়ে স্ত্রীর দৌড়ে বেড়ানো, অন্তঃস্বত্বা স্ত্রীর সন্ধানে স্বামীর হাহাকার। এক মেয়ে পুড়েছে তাজরীনের আগুনে, আরেক মেয়ে আটকে আছে রানা প্লাজার ফাঁদে। সবার হাতে হাতে প্রিয়জনের ছবি- “ভাই, আমার বোনটারে দেখছেন।” বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন অন্তত লাশটা চাই। গ্রামে নিয়ে কবর দিবেন। আর ফিরবেন না ঢাকায়। এমন কত শত কান্না সাভারের আকাশে বাতাসে। সাভারের সেই শোক এখন গ্রাস করেছে গোটা বাংলাদেশকে।

আমি বাংলাদেশকে খুব খুব ভালোবাসি, সবাই বাসে, আমিও বাসি, একটু আদেখলার মতোই। আমার ক্লাশ ফাইভে পড়ুয়া ছেলে প্রসূন এটা নিয়ে মজা করে। বাংলাদেশ খেলায় হারলে, লঞ্চ ডুবলে, সড়ক দুর্ঘটনা হলে, হরতাল হলে, মারামারি হলে, আগুন লাগলে, ভবন ধ্স হলে সে আমাকে ক্ষেপায়- কী বাবা, তোমার বাংলাদেশের খবর কী? দোষারোপের রাজনীতি দেখে সে খুব মজা পায়। বুধবার রাতে বাসায় ফিরতেই সে বললো, বাবা সাভারের ভবন ধসের জন্য কী হাসিনা খালেদাকে আর খালেদা হাসিনাকে দায়ী করেছে? আমি বললাম, না। কিন্তু আমার ছেলের খেয়ালি প্রশ্ন আর আমার বুনো কল্পনাকেও হার মানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, “হরতাল সমর্থক কতিপয় ভাড়াটে লোক সেখানে গিয়ে ফাটল ধরা দালানের বিভিন্ন স্তম্ভ ও গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে। এটাও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।” হায় হায়, একি শুনছি! একি কোনো সুস্থ মানুষের কথা হতে পারে। এ দেখি ‘লুকিং ফর আল্লার মাল।’ এর আগে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি বিবেচনার আশ্বাস দেওয়ায় আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অপসারণ বা পদত্যাগ (যেটা আগে সম্ভব) দাবি করেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি ওনাকে তালা মেরে রাখা উচিত। খবরটি শুনে আমি বললাম, “এমন একজন শিক্ষিত ডক্টরেট ডিগ্রিধারী মানুষ এমন কথা বললেন কী করে।” শুনে আমার স্ত্রী বললেন, “হয়তো উনি আগে সুস্থই ছিলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর এমন হয়ে গেছেন। এটা আসলে ওনার দোষ না। এটা পদের দোষ।”

আলতাফ চৌধুরীর ‘আল্লার মাল’, বাবরের ‘লুকিং ফর শত্রুজ’, সাহারা খাতুনের ‘তালা তত্ত্ব’- সবকিছু ছাড়িয়ে যাবে এই ‘নাড়াচাড়া তত্ত্ব’। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, উনি হয়তো মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে উনি সচিবালয়ে রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে তার এই ‘নাড়াচাড়া তত্ত্ব’ প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। এই তত্ত্ব সত্যি হলে সময় এসেছে, তার গদি ধরে একটু নাড়াচাড়া দেওয়ার। গদি ধরে মারো টান, মন্ত্রী হবে খান খান। আর এই তত্ত্ব সত্যি হলে দেশের অনেক খরচ বেঁচে যাবে। কোথাও কোনো ভবন ভাঙার দরকার হলে বুলডোজার লাগবে না। সাভারের বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের ডেকে আনলেই চলবে। তবে আরেকটা ভবনে নাড়াচাড়া করার সময় চলে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় হাতিরঝিল প্রকল্পের ‘বিষফোঁড়া’, সবাই যেটাকে ‘গার্মেন্টস মালিকদের লোভের মিনার’ বলেন, সেই বিজিএমইএ ভবনটি ধরে সবার জোরে নাড়াচাড়া করা দরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা শুনে আমার হাসি পেয়েছে। চোখে কান্না, মুখে হাসি- আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?

শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নন, সাভারের ভবন ধস নিয়ে হাস্যকর কাণ্ড-কারখানা করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে রানা প্লাজা যখন ধসে পড়ে তখন ১৮ দলের ডাকে ৩৬ ঘণ্টা হরতাল চলছিল। প্রধানমন্ত্রীও উদ্ধারকাজে সুবিধার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রতি হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। এতবড় বিপর্যয়ের পরও তাদের হরতাল প্রত্যাহার করতে ৭ ঘণ্টা লেগেছে, তাও তিন দফায়। প্রথমে শুধু সাভারে, তারপর ঢাকা মহানগরীতে, আর শেষ পর্যন্ত হরতাল শেষ হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে সারাদেশে হরতাল প্রত্যাহার করা হয়। হরতাল ডাকতে যাদের ৭ সেকেন্ডও লাগে না, ককটেলের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই হরতালের ঘোষণা চলে আসে, হরতাল প্রত্যাহার করতে তাদের ৭ ঘণ্টা লাগবে কেন? তারা নাকি ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারেননি! এরা নাকি জনগণের জন্য রাজনীতি করে! সাংবাদিকরা যে ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারেন ৭ মিনিটে, সারাদিন টিভিতে লাইভ দেখার পরও সেই ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে তাদের ৭ ঘণ্টা লাগে! বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ার প্রশ্ন তুলেছেন, হরতালের দিন সেখানে এত শ্রমিক কাজ করছিল কেন? হায়রে রাজনীতি!

রাজনীতিবিদরা নিষ্ঠুর। কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো। যেকোনো দুর্যোগে তারা এগিয়ে আসে সবার আগে। সাভারেও তারা বুক চিতিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে উদ্ধারকাজে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবির পাশাপাশি হাজার হাজার সাধারণ মানুষও স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছেন সাভারে। যেখানেই রক্ত দরকার সেখানেই লম্বা লাইন পড়েছে। শুকনা খাবার দিয়ে, পানি দিয়ে, ওষুধ দিয়ে, অক্সিজেন দিয়ে আটকা পড়া মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার কী প্রাণান্তকর চেষ্টা।  জীবিত কাউকে উদ্ধার করতে পারলেই উল্লাস, যেন নিজের ভাই বেঁচে এসেছে। কারো লাশ বেরুলেই কান্নার রোল, যেন আমাদের অন্তর ছিড়ে গেল। বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা তো আছেনই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষগুলো ঢুকে পড়েছে ধসে পড়া ভবনের কবরের মতো মৃত্যুগুহায়। কোনো প্রশিক্ষণ নেই, জীবনে কোনোদিন এমন কাজ করেননি, ভেতরে নিজের স্বজনদের কেউ আটকে পরেনি- তারপরও অসংখ্য মানুষ বুকভরা সাহস আর আটকা পড়া মানুষগুলোর জন্য মমতা নিয়ে মাকড়সার মতো ঢুকে পড়ছেন স্যান্ডউইচ হয়ে যাওয়া রানা প্লাজায়। ঔষধ, পানি, খাবার, অক্সিজেন যে যা পারছেন, তাই নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন পাশে। এই আমাদের বাংলাদেশ, এই আমাদের শক্তি।

বাংলাদেশে গার্মেন্টস খাতেই দুর্ঘটনা মানেই মৃত্যুর মিছিল। ‘হাফ সেঞ্চুরি, সেঞ্চুরি’ হয়ে যায় অবলীলায়। এবার তো সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে মনে হচ্ছে। এই খাতটি দেশের অর্থনীতির প্রাণ। আর এই অর্থনীতির কথা বলে তারা বারবার আমাদের ব্ল্যাকমেইল করেন। হাতিরঝিল প্রকল্পে অবৈধভাবে বানানো ভবন এক প্রধানমন্ত্রী ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, আরেক প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন। তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি। সেই মুদ্রায় ভাগ্য বদলায় কার? উদয়াস্ত পরিশ্রম করার পর শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ৩ হাজার টাকা, যেটা আমাদের গার্মেন্টস মালিকদের এক বিকালের চায়ের বিল। ডলার-ইউরোয় চকচক করে আমাদের মালিকদের চেহারা, ঘন ঘন বদলায় গাড়ির মডেল। বদলায় না শ্রমিকদের ভাগ্য। কোনো দুর্ঘটনা হলেই বিজিএমইএ নেতারা বড় বড় কথা বলেন, আশ্বাস দেন, তদন্ত করেন, কমিটি করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। তাজরীন গার্মেন্টসে আগুন লেগে ১১২ জনের মৃত্যুর ক্ষত শুকানোর আগেই তার চেয়ে বড় বিপর্যয় সাভার ট্র্যাজেডি। প্রতিটি দুর্ঘটনার সময়ই আমরা বলি স্মরণকালের সবচেয়ে বড়। সত্যি আমরা পারিও। প্রতিবারই আগের বারকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। তবে সাভারের রানা প্লাজার ধ্স মনে হয় শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব রেকর্ড গড়বে। এতবড় মানবিক বিপর্যয় এর আগে আর কোথাও হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারের ধসের ঘটনাটি মাথায় রেখেও এটাকেই সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় বলছি। কারণ টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল মুহূর্তের মধ্যে। আর রানা প্লাজায় তিলে তিলে মরছে মানুষ। আমি নিশ্চিত এবারও নিহতদের জন্য টাকার ঘোষণা আসবে। “ঝাটা মারি আপনাদের টাকায়। টাকা চাই না, আমরা আমাদের শ্রমিক ভাইবোনদের নিরাপত্তা চাই।” এক বাবা সাভারে ধসে পড়া ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে তার ছেলের খোঁজ করছিলেন, আর বলছিলেন, “আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন। আর ঢাকায় থাকবো না, গ্রামে চলে যাবো।” আমরাও তাই বলছি, আমরা অর্থনীতি বুঝি না। আমরা বুঝি জীবন। জীবনের চেয়ে দামি কিছু নেই। আমরা ভাইবোনরা গ্রামে একবেলা কম খেয়ে গলাগলি করে থাকবো। তবু আমার বোনটি বেঁচে তো থাকবে।

অনেকে বলছেন, এটি দুর্ঘটনা। আমার তীব্র আপত্তি এতে। কোনোভাবেই এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড। কারণ রানা প্লাজা আসলে বহুতল ভবন নয়, ছিল একটি মৃত্যুফাঁদ। সাভারের যুবলীগ নেতা সোহেল রানা বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। অনেক পত্রিকা লিখেছে, কলু থেকে কোটিপতি রানা। পারিবারিকভাবে তাদের তেলের ঘানির ব্যবসা ছিল। ক্ষমতার দাপটে রানা বিতর্কিত জায়গার পুকুর ভরাট করে নির্মাণ করেছেন রানা প্লাজা। অনুমোদন ছিল ৫ তলা, বানিয়েছেন ৯ তলা। বইয়ে ‘তাসের ঘর’-এর কথা পড়ি। কখনো দেখিনি। এবার দেখলাম। রানা প্লাজা ছিল আসলে তাসের ঘর, মৃত্যুফাঁদ। সোহেল রানা নিজের ভবন তৈরির সময়ও ভালো ইট-সিমেন্ট-রড ব্যবহার করেনি। ভেঙে পড়ার পর উদ্ধারকাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে সবকিছু ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে।

রানা প্লাজার ধসে পড়াকে আমি কিছুতেই দুর্ঘটনা বলতে রাজি নই। কারণ আগের দিনই ভবনটিতে ফাটল ধরেছিল। খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা। অনেক পত্রিকা এবং টিভিতে নিউজও হয়েছে। বিজিএমইএ প্রতিনিধিদল, শিল্প পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন, প্রকৌশলী সবাই পরিদর্শন করে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছিলেন। ভবনে থাকা চারটি গার্মেন্টস ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভবনটিতে থাকা ব্র্যাক ব্যাংকের শাখাটি বন্ধ করে সকল মূল্যবান জিনিস সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ৩ তলা পর্যন্ত শপিং মলের অনেক দোকানদারও তাদের মালামাল সরিয়ে নিয়েছিল। সবকিছুই দামি, শুধু আমাদের শ্রমিক ভাইবোনদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। বুধবার সকালে বেতন আটকে দেওয়ার হুমকিতে গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ রীতিমতো লাঠি দিয়ে তাড়া করে শ্রমিকদের গার্মেন্টসে ঢুকিয়ে ছিলেন। হিটলারের নাজি বাহিনী যেভাবে গ্যাস চেম্বারে মানুষ ঢুকিয়েছে সেভাবে। যেভাবে তাড়া করে হাতিকে খেদায় ঢোকানো হয়, সেভাবে প্রায় ৩ হাজার লেবারকে (গার্মেন্টস মালিকরা এদের আসলে মানুষ মনে করেন না, লেবার মানে তাদের কাছে মানুষ নয়) সেই মৃত্যুকূপে ঢোকানো হয়েছিল। সেই ভবনের বিভিন্ন তলায় তিনটি শক্তিশালী জেনারেটর চলে। জেনারেটর সৃষ্ট বাড়তি শক্তি আর ৩ হাজার মানুষের পদভার সইতে না পেরে রানা প্লাজা নামের এই তাসের ঘর ভেঙ্গে পড়ে। দুবেলা দুমুঠো খাওয়া আর মাথার ওপর একটা ছাদ- এই ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে আসা শ্রমিকদের মাথার ওপর ভেঙে পড়লো সেই ছাদ।

বারবার যা হয়, এবারও তাই হয়েছে, অন্তত ৫টি তদন্ত কমিটি, একাধিক মামলা। কিন্তু আমরা কোনো তদন্ত কমিটি চাই না, মামলাও চাই না। কারণ মামলা হয়েছে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা না মানায়। এর সর্বোচ্চ শাস্তি কী? নিশ্চয়ই মৃত্যুদণ্ড নয়। মামলা হলে হতে হবে হত্যা মামলা। এর আগের প্রত্যেকটি ঘটনার সময়ই তদন্ত কমিটি হয়েছে। তার কোনো রিপোর্ট কী আপনারা কখনো দেখেছেন বা সেই কমিটির কোনো সুপারিশ কি বাস্তবায়িত হয়েছে? তাজরীন গার্মেন্টসের মালিক কি গ্রেপ্তার হয়েছেন? স্পেক্ট্রাম গার্মেন্টসের মালিক নাকি কিছুদিন কারাভোগ করেছেন। ৮০ জনের মৃত্যুর দায় মাত্র কিছুদিন জেল! তাজরীনে ১১২ জনকে মেরেও মালিক ঘুরে বেরাচ্ছেন। রানা প্লাজা ধসে পড়ার সময় মালিক সোহেল রানাও বেজমেন্টে আটকা পড়েছিলেন। তিনি নাকি তখন হরতালবিরোধী মিছিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। খবর পেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য তৌহিদ জং মুরাদ ছুঁটে এসে তার ডান হাত সোহেল রানাকে উদ্ধার করে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন। এখন নাকি পুলিশ তাকে খুঁজছে। পুলিশ যদি সত্যি রানাকে গ্রেপ্তার করতে চায়, তাহলে তৌহিদ জং মুরাদকে ধরলেই হয়। তিনিই বলতে পারবেন সোহেল রানা কোথায়। কোনো তদন্ত দরকার নেই। অপরাধী শনাক্ত হয়েই আছে। একজন মানুষ মারলে যেখানে মৃত্যুদণ্ড হয়, শত শত মানুষ হত্যার শাস্তিও নিশ্চয়ই মৃত্যুদণ্ডই হবে। এখন প্রয়োজন চিহ্নিত অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর।

ভবন মালিক সোহেল রানা, ভবনে থাকা ইথার টেক্স গার্মেন্টসের মালিক মো. আনিসুর রহমান, নিউ ওয়েভ অ্যাপারেলস, নিউ ওয়েভ বটমস ও নিউ ওয়েভ স্টাইলের মালিক বজলুস সামাদ আদনান এবং ফ্যান্টম অ্যাপারেলস ও ফ্যান্টম টেক-এর মালিক আমিনুল ইসলাম; যার পরামর্শে পরিত্যক্ত ভবনে কাজ হয়েছে, যারা জোর করে শ্রমিকদের ভবনে ঢুকিয়েছে- তাদের গ্রেপ্তার করে জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক। এমনিতে আমি সব ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরোধী। ক্রসফায়ার, গণপিটুনি, গুম- আমি মানি না। কিন্তু বারবার শত শত শ্রমিকের এমন মৃত্যুর মিছিলে অসুস্থ আমি আমার সেই বিশ্বাস অন্তত একবারের জন্য হারাতে চাই। আমি চাই চিহ্নিত দায়ীদের অবিলম্বে মৃত্যু। তা গণপিটুনি, ক্রসফায়ার, ফাঁসি যেভাবেই হোক। কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। শোক চাই না, শাস্তি চাই, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর চাই। অনেকে বলছেন, আগে উদ্ধারকাজ শেষ হোক, তারপর বিচার, দায়, তদন্ত ইত্যাদি। মানছি উদ্ধারটাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। কিন্তু এই ফাঁকে যেন অপরাধীরা পালিয়ে যেতে না পারে।

পুনশ্চ : এই লেখা যখন ছাড়ছি, তখন উদ্ধার করা হয়েছে ৩০৭ জনের লাশ। এখনও আটকে আছেন অনেকে। যত সময় যাচ্ছে, ততই বেঁচে থাকার আশাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। সাভারের বাতাসে এখন লাশের গন্ধ। অক্সিজেনের চাহিদা কমে আসছে, বাড়ছে এয়ার ফ্রেশনার, ব্লিচিং পাউডার আর সাদা কাপড়ের চাহিদা। আহারে আমরা কত অসহায়! আমরা সবাই খাচ্ছি, দাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি। আর আমাদের সবার চোখের সামনে মানুষগুলো ধুকে ধুকে মরে যাচ্ছে, যারা কিনা দেশের অর্থনীতি সচল রাখতো। তারাই আজ নিশ্চল নিথর হয়ে পড়ছে একে একে। কী কষ্ট, কী কষ্ট। বুক ফেটে কান্না আসে, আর সহ্য হয় না। ইচ্ছা করে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে দূরে কোথায় চলে যাই। ইচ্ছা করে হাউমাউ করে কাঁদি, গলাগলি করে কাঁদি, গড়াগড়ি করে শোক করি। চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া, করিতে পারি না চিৎকার। এই নিষ্ঠুরতা সওয়া যায় না, চোখে দেখা যায় না।

 

প্রভাষ আমিনঃ সাংবাদিক।।

probhash2000@gmail.com

অতিথি লেখক