শাহাবাগ চত্বরঃ এক বিরল দৃষ্টান্ত

শাহাবাগ চত্বরঃ এক বিরল দৃষ্টান্ত

রাহাত শিকদারঃ একদিকে যখন দেশের মেধাবী তরুণদল, মেধাবী ছাত্রসমাজ শাহাবাগ চত্বরে সমবেত হয়ে ভীষণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে, সেই সাথে যোগ দিয়েছে বিক্ষুব্দ উত্তাল জনতা, ঠিক তখনই ফুঁসে উঠেছে একোন বিদগ্ধ চিত্র? লাখো জনতা যখন মানবতাবিরোধী অন্যায়ের বিরুদ্ধে একাকার সেই জনতার মঞ্ছেই আহত করা হোল তেজস্বী নেতাকে । তথাকথিত ছাত্রসমাজের নামে একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাণ্ডব চালালো এবং চালিয়ে যাচ্ছে খোদ ঢাকার অন্য এক প্রান কেন্দ্রে, আঘাত থেকে রেহাই দেয়নি খ্যাতনামা এক সম্পাদকসহ অনেক দেশবরেণ্য ব্যাক্তিদেরকে। সেই সাথে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তথা এই সরকারযন্ত্র ব্রজ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার হাত থেকে রক্ষা করতে পারলনা । গুরুজন হিসেবে না হলেও একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তিনি রক্ষা পেলেন না ছাত্রলীগের ছাত্র বাহিনীর বেরধক মারপিট থেকে । গত বছরের ২৯ জুলাই তারিখে দৈনিক প্রথম আলো এর একটি প্রকাশিত সংবাদ উল্লেখ না করলেই নয় যে বগুরার শেরপুরের জনৈক যুবলীগ নেতা মাতৃতুল্য ৫৪ বছর বয়সের এক প্রধান শিক্ষিকাকে এলোপাথাড়ি চড় থাপ্পড় মেরেই ক্ষান্ত দেননি বরং তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে করতে রাস্তার উপরে এনে জন সম্মুখে হেনস্তা করার মত বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। তাহলে কোথায় আমাদের প্রশাসন কোথায় আমাদের জন নিরাপত্তা । কোথায় রইল আমাদের নাগরিক অধিকার । এদের পেছনে কোন অশনি সংকেত! আর এর দায়ভারই বা কার? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষমন্ত্রী মহোদয় কি এরপরও বলবেন আমরা ভাল আছি নাকি এর থেকে বেশি ভাল থাকা যায় না।  পিতৃতুল্য আর মাতৃতুল্ল শিক্ষক – শিক্ষিকা এর উপর এরূপ নির্মম শারীরিক নির্যাতন আর একাত্তরের যুদ্ধ অপরাধ যদি একই গুরুত্ব বহন না করে তাহলে এ জাতি নির্বাক অভিশাপে অভিশপ্ত। তাই অতিসত্বর এই ঘটনাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে আখ্যা  না দিয়ে আশু ব্যাবস্থা গ্রহণের নিস্ফল দাবি রইল । এই সকল তথাকথিত বিপথগামী ছেলেদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে দেশের সরকার ব্যাবস্থার ইমেজ রক্ষা ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এর মহান দায়িত্ব জনগণ আপনাদের হাতেই তুলে দিয়েছিলো । রাজারনীতি যে প্রজার নীতির সমষ্টি তা আপনাদের ভালো করেই জানা আছে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস । তারই এক বিরল দৃষ্টান্ত এই শাহাবাগ চত্বর । যে গনমিছিলে যোগ দিতে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ও নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নাই । অবস্থা দৃষ্টে এ কথা অতি পুরানো হয়ে গেছে যে এ দেশের ছাত্র সমাজের এক অংশ সমূহ বিপথগামী । একটা লেখায় পড়েছিলাম যে আজকাল আর কুকুরে লেজ নাড়েনা  বরং লেজই কুকুরকে নাড়ায় । আমদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং ছাত্ররাজনীতির সম্পর্ক এখন ঠিক তেমন অবস্থায় উপনীত ।  কেননা সকল রাজনৈতিক দলই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব লেজুড়বৃত্তি ছাত্ররাজনীতিকে তাদের স্বার্থান্বেষী রাজত্ব কায়েমের একমাত্র হাতিয়ার মনে করেন এমনকি মনেপ্রানে তাই লালন করেন । এখন রাজনৈতিক পিতামাতা বা রাষ্ট্রযন্ত্রের অধিকর্তা দিয়ে দেশের মানবিক সভ্যতা আর জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা সম্ভব নয় বলেই মনে হচ্ছে । গতানুগতিক স্বাভাবিক ধারায় চলে, ক্যান্সারের মতন জীর্ণ ব্যাধি শিক্ষাসন্ত্রাসের হাত থেকে পবিত্র শিক্ষাঙ্গনগুলোকে রক্ষা করা সম্ভবপর নয় । তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই কুলাঙ্গার বনে যাওয়া, লেজুড়বৃত্তি রাজনৈতিক ছত্রছায়ার মরীচিকার পেছনে ছোটা এই বিপথগামী ছাত্রদেরকে সামজিকভাবে বর্জন আর রুখে দারাবার সময় এসেছে । ওদের পিতা-মাতাদেরকে ধিক্কার জানাবার সময় এসেছে । ওদের পিতামাতার যে সামাজিক দায়িত্ব তা তাদের কঠোর হস্তে পালন করতে হবে । প্রত্যেক পিতামাতাকে তাদের সন্তানদের খোঁজ জানতে হবেই । নইলে ওইসব পিতামাতা যারা জেনেও না জানার ভান করে ছেলের উম্মাদনা দেখতে ভালবাসেন তাদেরকেও সামজিক অবক্ষয়ের দায়ভার নিতে হবে । অর্থাৎ ওই সকল ছাত্র নামের অছাত্রদের সাথে তাদের পরিবারের গুরুজনদেরকেও সামাজিক জবাবদিহিতা করতে হবে বৈকি । সম্প্রতি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদিসহ সর্বশেষ ব্রজ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এর মর্মান্তিক খবরগুলো শুধুই শেষ করে দেয়নি কতগুল তাজা তাজা তরুণ ও মেধাবী প্রান এমনকি অবুঝ শিশুকেও, নিঃশেষ করে দিয়েছে নিজ মন্ত্র ছাত্রনং অধ্যায়নং তপঃ । ধিক্কার দেই ওদের রাজনৈতিক পিতামাতা আর অবশ্যই অসহ ও নেতিবাচক এই ছাত্ররাজনীতির ধারাকে ।

শিক্ষা সন্ত্রাসের পেছনে শুধু কোমলমতি ছাত্রসমাজকেই দায়ী করলে চলবেনা । শিক্ষাঙ্গনগুলোতে যখন গুরুজনেরাই ক্ষমতা আর স্বেচ্ছাচারিতার শক্তি সঞ্চয়ে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি পেশায় পিছপা নন সেখানে ছাত্রসমাজের মননশীলতার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী । বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা উপাচার্যের পদে আসীন থাকেন তারা নিঃসন্দেহে এই জাতির সেরা শিক্ষিতজন । বিগত বিশ বছরে কোন উপাচার্যই স্বাভাবিক নিয়মে পূর্ববর্তী পদে ফিরে যাননি বা যেতে পারেন নাই । এমনকি বরেণ্য ব্যাক্তিদের কারো মুখে ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচন এর একটি শব্দও শোনা যায় নাই । কারন  ওনারাও রাজনৈতিক তাবেদারি করে উপাচার্য পদে আসীন হন বা হতে হয় । তাই তথাকথিত ছাত্র রাজনীতি সাময়িক ভাবে বন্ধ করে বা স্থগিত করে ছাত্র সমাজকে সঠিক ধারায় আনতে হবে । লেজুরবৃত্তি ছাত্র রাজনীতি সমুলে উৎপাটন করতে হবে । দেশের মহা সংকটে ছাত্রসমাজ এক শ্লোগানে এগিয়ে আসবে যেমনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ৫২’,  ৬৯’, ৭০’, ৭১’, ৯০’ এ । যেমনি আজকে ২০১৩ সালে ছাত্রসমাজ আবার এক হতে পেরেছে ৭১’ এর নরপিশাচের সঠিক বিচারের গণদাবিতে । ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচন বন্ধ রেখে মেধাবী রাজনীতি হত্যার নীলনকশা ও সমূহ চক্রান্ত রুখে দাড়াতে হবেই হবে । যতদিন মেধাবী রাজনীতি এর পুনরুদ্ধার না ঘটবে ততদিন গণতন্ত্রের খোলসে পরিবারতন্ত্র এই রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘাড়ে বসে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবেই । এ জাতির জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কি আছে যে, সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে ছাত্র হয়ে এসে পিতারমাতার কোমলমতি সু-সন্তানেরা অবশেষে অছাত্র, পিতামাতার জন্য কুলাঙ্গার সন্তান আর সমাজ বিরোধী হয়ে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে । ছাত্রকে অছাত্র করে তোলার কারখানা  হয়ে যাচ্ছে শিক্ষাঙ্গনগুলো । এর জন্য দায়ী এক কথায় “লেজুড়বৃত্তি আর মেধাশূন্য ছাত্ররাজনীতি”, সেই সাথে রাজনৈতিক তাবেদার শিক্ষাঙ্গনের গুরুজনেরাও বটে । একথা অনস্বীকার্য যে, দেশ আজ শুদ্ধ রাজনীতির পথে ধাবমান নয় বরং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এখন মহা পরাক্রমশালী । এই দুর্দশা থেকে উত্তরন হতে যাদের অবদান তারাইতো আজ বিপথে, আমাদের ছাত্রসমাজ!! সকল প্রকার অপরাধ আর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের পেছনে চলে আসে কোন না কোন ছাত্রের নাম । আজ কোঁথাও কোন অপরাধ সংগঠিত হলে ছাত্রসমাজ তার প্রতিবাদ করতে এক পতাকা তলে আসতে পারেনা । অপরাধিচক্র কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেয়ে গিয়ে যথারীতি ন্যায় প্রতিবাদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় ।

এই লজ্জা কার! জাতি বা এ জাঁতেরে তোমরা কি দিলে উপহার । তোমরা যারা বিপথগামী তারা শাহাবাগ চত্বর আর তারুন্ন্যের উৎস নও, হতে পারবেনা । তোমাদের প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় অন্যায়ের কুণ্ডলী ঝলসে যায় না । আর কতকাল সাধারণ ছাত্রের নাম দিয়ে আর রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির খোলসে থেকে যা খুশি তাই করে যাবে । আগেই বলেছি তোমাদের জন্মদাতা পিতামাতা থেকে রাজনৈতিক পিতামাতার মূল্য এখন অনেক বেশি । সেইখানে পিতৃতুল্য মাতৃতুল্য  শিক্ষক আর সুধিজনেরা তোমাদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি আর কি আশা করবে । আর কিছু বলাটা মনে হয় বেমানান। প্রশাসনের কাছে যেখানে শিক্ষকের কথা (বি এম কলেজের অধ্যক্ষ এর লিখিত অভিযোগ) মিথ্যে বনে গেলো সেখানে এই পর্যন্ত ইতি টানাটাই শ্রেয় । শুধু বিদ্রোহী কবি নজরুলের একটি পঙক্তি দিয়ে, “দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝী পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল আছে কার হিম্মত”!!

রাহাত শিকদারঃ গবেষক, সাংবাদিক ও লেখক 

বর্তমানে আফগানিস্থান সরকারের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বরত।।

rahat0481@yahoo.co.uk

অতিথি লেখক