এই বিজয়ই কি সেই বিজয়?

এই বিজয়ই কি সেই বিজয়?

মীর আব্দুল আলীমঃ আমার বাবা কাঁদে কেন ? টিভি সেটের সামনে বসলে কাঁদেন; পত্রিকা পড়লে কাঁদেন; জামাত-শিবিরের তান্ডব দেখলে কাঁদেন ; ছাত্রলীগের দানবীয় রূপ দেখলে কাঁদেন। খুন হলে কাঁদেন, গুম হলে কাঁদেন। ভাবেন এই দেশটাই কি বাবার স্বাধীন করা সেই দেশ। ৪২ বসন্ত পার করা এই দেশটাই কি আমাদের বিজয় হওয়া সেই দেশ ? কৃষক যুবা, তাঁতি, মজুর, কামার, কুমারের দেশতো হাজারো লাশের দেশ হওয়ার কথা নয় ? রক্তাক্ত কসাইখানা আমাদের দেশ হয় কি করে ? এতো দেখি সন্ত্রাসীদের উল্লাশ মঞ্চ। কখনো ছাত্রলীগ ; কখনো  ছাত্রশিবির আবার কখনোবা ছাত্রদলের তান্ডব খানা মনে হয় দেশটাকে। এসব দেখতে দেখতেইতো কেটে গেল ৪২টা বছর। আমি আর দেশটা যে সমবয়সী। কালে কালে তো অনেক কিছুই দেখলাম । এই মৃত্যু-উপত্যকা কিছুতেই আমাদের দেশ না। যদি বলি আজ যে দেশ আমরা দেখছি তা কেবলই তপ্ত অগ্নিকুন্ড ,ঘুষখোর, পাপিষ্ঠ আর চাপাবাঁজদের দেশ ? রাজাকার আর আলবদরদের দেশ; দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, খুনিদের দেশ ? মস্ত ভূল হবে আমার ? উত্তরটা না হয় পাঠক আপনারাই দেবেন আজ ।
আমাদের চারিদিকে শুধু মৃত্যুর বিভীষিকা।দেশে স্বাভাবিক মৃত্যু কেন আজ অস্বাভাবিক । আমরা কেন কোথাও নিরাপদ নই ? ঘরেও না; বাহিরেও না। নিজ ঘরে থাকবেন ?  সাগর রুনী অথবা ফরহাদ দম্পতিদের মত খুন হবেন। রাস্তায় যাবেন ? ইলিয়াছের মত গুম হবেন ; যেকোনো সময় হুড় মুড় করে আপনার উপরই ভেঙ্গে পড়তে পারবে ফ্লাই ওভারের গাড কিংবা যান্ত্রীক দানব বাস ট্রাকে চাপা দিয়ে কেড়ে নিতে পারে আপনার প্রাণ। কর্মস্থলে থাকবেন ? সর্বনাশা আগুনে যে আঙ্গার হবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায় ? নদীতে যাবেন ? সেখানেও লঞ্চ ডুবিতে প্রাণ যাবে। কোন নিরাপত্তা নেই, কোন গ্যারান্টি নেই জীবনের, যখন যেখানে সেখানে মৃত্যু। ফ্লাইওভার ভেঙ্গে পড়ছে, ব্রিজ ভেঙ্গে পড়ছে, বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ছে। যা কিছু মানুষের সৃষ্টি, সবই ভেঙ্গে পড়ে মানুষের ওপর। ভাগ্যিস আকাশটা সৃষ্টিকর্তার গড়া ছিলো ! তা না হলে সেটাও যে ভেঙ্গে পড়ত ঘাড়ে। সিমান্ত হত্যা, গুম ,খুন,আর ক্রসফায়ারে  ভয়াল মৃত্যু আজ ওত পেতে আছে আমাদের সামনে। আজ স্বাভাবিক মৃত্যুই যেন অস্বাভাবিক। মানুষে মানুষ মারছে নির্দয়ভাবে। শত শত মানুষ আগুনে দগ্ধ হয়ে পুড়ে, মরছে  নানা দুর্ঘটনায়। পথে ঘাটে এমনকি বাসাবাড়িতে মানুষ খুন হচ্ছে। রোধ হচ্ছে না। কিন্তু কেন?
মুক্তিযুদ্ধের কথা এলেই যার নাম নিতে হয় তিনি সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাশাপাশি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে আসে আরও অনেকের নাম। তারা আজ নেই। তবুও জাতীর কাছে অবিস্মরণীয় তারা। লজ্জার সাথে বলতে হয় যারা যুদ্ধ করেছিলেন দেশের জন্য; পরাধিনতা থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতা দিয়েছেন বাঙ্গালী জাতিকে সেই মহান ব্যক্তিদের নিয়ে; সেই স্বাধীনতা নিয়েই, আজও যুদ্ধ চলছে দেশে। এদেশের মানুষ স্বাধীনতা চেয়েছিল স্বাধীন ভাবে বাঁচার জন্য; পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে; স্বাধীনভাবে একটু কথা বলতে; একটু মুক্ত জীবনের আশায়। এটাতো মোটেও সেই স্বাধীনতা নয়। প্রশ্ন জাগে – ৪২ বসন্ত পার করা আমাদের এই স্বাধীনতাই কি সেই স্বাধীনতা ? আমাদের প্রত্যাশিত স্বাধীনতাই কি আজকের এই স্বাধীনতা ? সংসদে গিয়ে অবলিলায় অশ্লিল বাক্য প্রয়োগ আর খিস্তি খেউড়ের জন্যই কি স্বাধীনতা ? মিথ্যা বলার জন্যই কি স্বাধীনতা ? স্বাধীনতার ঘোষক খুঁজে না পাওয়ার জন্যই কি স্বাধীনতা ? দেশদ্রোহিতার জন্যই কি স্বাধীনতা ? রাজনৈতিক হানাহানির জন্যই কি স্বাধীনতা? কথায় কথায় হরতালের জন্যই কি স্বাধীনতা ? খুনোখুনি রাহাজানী আর রাষ্ট্রীয় চুলোচুলির জন্যই কি স্বাধীনতা ? মাদকে বুদ হওয়ার জন্যই কি স্বাধীনতা ? ঘুষ দুর্নিতির জন্যই কি স্বাধীনতা ? অস্ত্রবাজী- টেন্ডারবাজীর জন্যই কি স্বাধীনতা ? ক্রসফায়ারের জন্যই কি স্বাধীনতা ? সত্য না বলার জন্যই কি স্বাধীনতা ? কিসের জন্য স্বাধীনতা অন্তত আমার জানা নেই। যে স্বাধীনতা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে তা স্বাধীনতা নয়। তাইতো আজ শিল্পিরা গায়-“বলার জন্য কি বলছি;শোনার জন্য কি শুনছি ; ৪২ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকেই খুঁজছি।” এত বছর পর কেন স্বাধীনতাটাকে খুঁজতে হয়- এ প্রশ্নের উত্তর কারোই হয়তো জানা নেই।
মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে বিজয় ছিনিয়ে এনে এ দেশের বীরজনতা বুঝিয়ে দিল, ঐক্য ও ত্যাগ থাকলে বুলেট আর কামান দিয়ে কোনো জাতিকে দমিয়ে রাখা যায় না। আমরা স্বাধীন হয়েছি ঠিকই, স্বাধীনতার চলি¬শ বছর পর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আমাদের প্রকৃত মুক্তি কি অর্জিত হয়েছে ? আমরা কি আজ সত্যিই স্বাধীন ? স্বাধীন হলেও এমন স্বাধীনতাই কি আমরা চেয়ে ছিলাম ? বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের তিন যুগ পার করে ২০১২ সালে এমন প্রশ্নই জাগা স্বাভাবিক। এদেশের মানুষের প্রকৃত মুক্তি অর্জিত হয়নি ইতিহাসই তা আজ সাক্ষ্য দিচ্ছে। এখনও অর্জিত হয়নি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। একদল শোষকের স্থান নিয়েছে আরেকদল শোষক। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা একটি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা আজও গড়ে তোলা যায়নি। স্বাধীনতা, লাল সবুজের পতাকা আর মানচিত্রের আড়ালে আমাদের উপর চেপে বসে আছে সাম্রাজ্যবাদ, সমপ্রসারণবাদসহ বিদেশিদের ও তাদের এদেশিয় দালালদের নির্মম শোষণ। অথচ স্বাধীনতার ইতিহাস কতই না কষ্টার্জিত। কত যাতনা ভরাই না এ ইতিহাস। দেশে এখনও যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধ শেষ কোথায় ? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এদেশের আমজনতা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তিনি অবিস্মরণীয়। তখন জেনারেল জিয়াউর রহমানের ভূমিকাও ছিল আকাশ ছোঁয়া। রাজাকার ছিল হাতে গোনা ক’জন মাত্র। খারাপতো সর্বকালেই বিরাজমান। যারা যুদ্ধ করেছেন; যুদ্ধ করিয়েছেন তাদের নিয়ে আজও কেন এত হৈ হট্টোগোল । কৈ তাঁরা বেঁচে থাকতে তো এ নিয়ে বিতর্ক ছিল না। তবে এ নিয়ে এত বিতর্ক কেন ?
মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙ্গালী জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের পবিত্র রক্ত, দু’লাখ মা বোনের স্বভ্রম অনেক অশ্রু ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাঙ্গালী জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে মহত্তম ও গৌরবময় ঘটনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদিকে যেমন করুণ, শোকাবহ, লোমহর্ষক, তেমনি ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল ও বীরত্বপূর্ণ। ১৯৭১ এর মহান সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের প্রতিটি দিনই কোনো না কোনোভাবে তাৎপর্যবহ। মুক্তিযুদ্ধ বাঙ্গালী জাতির আনন্দ ও বেদনার এক সংমিশ্রিত ইতিহাস। মাত্র ৯ মাসের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা কি এতই সস্তা ? স্বাধীনতা অর্জনে অনেক ত্যাগ রয়েছে। শুধু ৭১এ এই যুদ্ধ হয়নি। স্বাধীনতার জন্য আরও বহু আগে থেকেই যুদ্ধে নামতে হয়েছে বাঙ্গালী জাতিকে। যাদের বয়স ষাটোর্দ্ধ তারা দেখেছেন আর আমরা শুনেছি ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগকে বেশ ভালোভাবেই প্রস্তত করে নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাধারণ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতে পারে সম্ভবত এ আশঙ্কা থেকেই ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন ইস্কান্দার মীর্জা। কিন্তু সামরিক জান্তার পুতুল ইস্কান্দার মীর্জাকে ক্ষমতা দখলের ২০ দিনের মাথায় দেশ থেকে বিতাড়ন করে প্রধান সেনাপতি জে. আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির মাধ্যমে সর্বময় ক্ষমতা করায়ত্ব করেন। সে সময় শেখ মুজিবসহ পূর্ব পাকিস্থানের আরও অনেককে জেলে নেয়া হয়। নির্যাতন করা হয়। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর সামরিক আইনের বেড়াজালের মধ্যেও মুজিব দলকে গোছাতে থাকেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৪ সালের ৫ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন। শেখ মুজিব এ সময় একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি লাহারে পাকিস্থানের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি ৬ দফা পেশ করেন। মুজিব জানতেন, পাকিস্থান সামরিক চক্র ৬ দফা দাবি মেনে নেবে না। আর এ ৬ দফা দাবি একদিন এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হবে। মুজিবের ৬ দফা ১৯৬৬-এর মার্চে অনুষ্ঠিত দলীয় সম্মেলনে ইশতেহার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। শেখ মুজিব এবং তার দলের নেতারা ৬ দফা দাবি প্রচারের জন্য সারাদেশ চষে বেড়ান। ৬ দফা পেশের পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব হুমকি দেন। শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে সামরিক জান্তা। ৬ দফা প্রচারকালে শেখ মুজিবকে বেশ কয়েকবার গ্রেফতার করা হয়। এ সময় সারাদেশে আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের শত শত নেতা-কর্মী গ্রেফতার হন। নির্যাতনের কাছে মাথা নত না করায় শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ১৯৬৪ সালের ১ জানুয়ারি নয়া ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। ১৭ জানুয়ারি গভীর রাতে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে এ ষড়যন্ত্র মামলায় নতুনভাবে গ্রেফতার দেখিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় ৩৫ জন আসামির ১ নম্বর আসামি করা হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে হত্যা করাই ছিল শাসকচক্রের মূল লক্ষ্য।আইয়ুব-মোনায়েম চক্রের এই উপর্যুপরি ষড়যন্ত্র ও নির্যাতনের কারণে আপোসহীন শেখ মুজিব জেলে থেকেই বাংলার মুক্তিকামী মানুষের একক নেতায় পরিণত হন। এ সময় শেখ মুজিব ও রাজবন্দীদের মুক্তিসহ ১১ দফা দাবিতে ছাত্র-জনতা আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। জনতার কাছে নতি স্বীকার করে ১৯৬৯ এর ২২ জানুয়ারি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সংবর্ধনা সভায় শেখ মুজিব ্তুবঙ্গবন্ধ্থু উপাধিতে ভূষিত হলেন।১৯৬৯ এর ২৫ মার্চ দশ বছরের স্বৈরশাসনের ইতি ঘটিয়ে আইয়ুব খান পদচ্যুত হন এবং জে. ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারির মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতা দখল করেন। বাঙালির পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও চাপের মুখে জে. ইয়াহিয়া নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন পেয়ে সারা পাকিস্থানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ। ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি পায় বঙ্গবন্ধুর দল। পূর্ব বাংলার জনগণের প্রায় ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে মুজিবের আওয়ামী লীগ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। নির্বাচনের পর ৩ জানুয়ারি জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের রেসকোর্স ময়দানে শপথ গ্রহণ করান বঙ্গবন্ধু। নির্বাচনের পর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমশি শুরু করে।
২৬ মার্চ রাত ১টা ১০ মিনিটের দিকে একটি ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং কয়েকটি ট্রাক বোঝাই সৈন্য শেখ মুজিবের বাড়ির ওপর দিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসে এবং তাকেসহ ৪ জন চাকর এবং একজন দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করে। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সীমানার পাশে লুকিয়ে থাকা একজন সৈন্য প্রহরীকে খুন করে। ২৬ মার্চ রাত তিনটার দিকে চট্টগ্রাম থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন মেজর জিয়া। আর সেই সঙ্গে নির্দেশ পাঠান ব্যাটালিয়নের সব পশ্চিমা অফিসারকে গ্রেফতারের। কেবলই ৯ মাস নয় সুদীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নেতৃত্বে বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষ স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছে। মূলত ১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত এই ২৬ দিনেই বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছিল, যার ফলে কখন স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল বা কে তা ঘোষণা করেছিল এ প্রশ্নটি অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করার যে প্রবণতা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে গ্রাস করেছে এটা তারই আরেকটি দৃষ্টান্ত; সত্যানুসন্ধান চিরায়ত ও সর্বজনীন প্রক্রিয়া। সত্যকে জানবার ও উদ্ঘাটনের প্রয়াসে মানুষ নিরন্তর নিয়োজিত, কিন্তু সত্যানুসন্ধান অত্যন্ত কঠিন কাজ, এ প্রয়াস প্রায়ই বিপথগামী হতে পারে আবেগ ও বিশ্বাসের কারণে। আর তাই হচ্ছে আমাদের দেশে।
স্বাধীনতার এতটা বছর পরও চলছে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে দ্বন্দ্ব। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কোন রকম আলোচনা কিংবা দ্বিমত কিংবা বিভাজন মুক্তিযুদ্ধের সময় কিন্তু ছিল না। এটা শুরু হয় স্বাধীন হওয়ার অনেক পর থেকে। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা মুক্তির যে শিখাটি প্রজ্বলিত করেছেন তাকে অনির্বাণ রাখতে তরুণ সমাজের দায়িত্বই সমধিক। তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের আদর্শ, শহীদদের আত্মদান, দেশপ্রেম ও দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে তারাই সন্ত্রাস, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের ভিত রচনা করবে। বাংলাদেশের ইতিহাসকে কি কখনও বিকৃত করা যাবে? মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং যে বিরাট সংগ্রামী ঐতিহ্যের অধিকারী এই বাঙালি জাতি, তাদের নিয়ে কি কোনো ধূম্রজাল সৃষ্টি করা কারও পক্ষে সম্ভব হবে? জাতি অর্জন করেছিল একটি জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত। স্বাধীনতা মানে ইচ্ছার স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্টভাবেই উচ্চারণ করেছিলেন : এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এই মুক্তির সংগ্রামে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামীদের মতোই স্বপ্ন ও সাহস নিয়ে এগিয়ে আসুক, আমাদের প্রধান মন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করে ঐক্যবদ্ধের শপথ নিয়ে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এটিই প্রত্যাশা।
(লেখক-মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিষ্ট, নিউজ-বাংলাদেশ ডটকমের সম্পাদক।)

অতিথি লেখক