আজ নয়ন সম্মুখে বাবা নেই!

আজ নয়ন সম্মুখে বাবা নেই!

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যে মানুষটির মেধা প্রজ্ঞা আর দূরদর্শী নেতৃত্ব একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কাঙ্খিত সাফল্যের পরিণতিতে পৌঁছে দিয়েছিলো সেই তাজউদ্দীন আহমদের কথা বিস্মরণপ্রিয় আমরা তো ভুলেই যেতাম, যদি না তাঁর সুযোগ্য কন্যা সিমিন হোসেন রিমি বছরের পর বছর ধরে তাঁর বাবাকে নিয়ে আবিরাম লেখালেখি এবং অন্যান্য কর্মকান্ড চালিয়ে না যেতেন। আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক প্রথিতযশা সাংবাদিক-লেখক সন্তোষ গুপ্তকে নিয়ে লিখছেন তাঁর পুত্র-কন্যারা। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনকে নিয়ে লেখেন তাঁর পুত্রদের কেউ কেউ-যেমন জাহিদ রেজা নূর। শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনকে নিয়ে তাঁর পুত্র সুমন জাহিদের লেখালেখির সুবাদে আমরা তাঁকে ভুলে যেতে পারিনি। মুক্তচিন্তার মুক্তবুদ্ধির অপরূপ রূপকার হুমায়ূন আজাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা প্রতিবছর হুমায়ূন আজাদের জন্ম এবং মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে নিয়ে লিখছেন, যেনো তাঁকে আমরা ভুলে না যাই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়-এমনি ভাবে জাতির আরো অনেক অনেক কৃতি সন্তানকে স্মরণ করছেন শুধুই তাঁদের পরিবারের সদস্যরা! যাঁদের পরিবারের সদস্যরা লেখালেখি করতে সক্ষম নন কিংবা লিখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে কি ঘটছে তাতো সহজেই অনুমেয়। কথাগুলো বলছি বিপন্ন ও বিষন্ন এক বেদনাবোধ থেকে। প্রথিতযশা ব্যক্তিদের জীবনের সব কর্মকান্ড, রচনাবলী আজ ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাচ্ছে। এখনকার নতুন প্রজন্ম চরমপত্র কি তা জানে না, বুঝতেও চেষ্টা করে না, পারে না চিনতে বিখ্যাত সাংবাদিক-কলামিস্ট-লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা সুনীল ব্যানার্জি-কী ভয়াবহ কথা! আজ ২০ এপ্রিল। তাঁর ৬৫তম জন্মবার্ষিকী। ২০০৬ সালের ২৮ আগষ্ট তাঁর আকশ্মিক মৃত্যু হয়। মৃত্যুর মাত্র পাঁচ বছর পার হতে না হতেই আমরা সুনীল ব্যানার্জিকে ভুলতে বসেছি? তাকে ভুলে যাওয়া অপরাধ। তাকে ভুলে যাওয়া পাপ।

এক সময়ের সাংবাদিকতা জগতের সকলের অতি প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় সুনীল ব্যানার্জি। অনেকের কাছেই তিনি আনন্দ-বেদনায় অনিবার্য আশ্রয়। এই মহান ব্যক্তি আমার পিতা। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। যার অনুপস্থিতি আমার প্রতিটি অসহায় মুর্হূতের নীরব স্বাক্ষী। ২০০৬ সালের ২৮ আগষ্ট আমাকে সম্পূর্ণ এতিম করে দিয়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন পরলোকের দূর অজনা সীমানায়। নয়নের বাইরে থেকেও বাবা রয়েছেন আমার হৃদয় গহীনে, প্রতিটি নিশ্বাসে, প্রতিটি মুর্হূত্বের নীরবতার প্রতীক হয়ে…!

প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে পৃথিবীতে কিছু মানুষ নিজের জন্যে জন্মায়। কিছু মানুষ জন্মায় শুধুই তাঁর পরিবারের জন্যে। কিছু মানুষ জন্মায় একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা এলাকার জন্যে এবং কিছু মানুষ-তাঁর পরিবার, তাঁর এলাকার সীমানা ছাড়িয়ে গোটা একটা দেশের জন্যে জন্মগ্রহণ করেন। আমার বাবা বিশিষ্ট সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জি এই শেষোক্ত গোত্রের। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার ছিলেন তিনি। দেশের স্বধীনতা সংগ্রামে প্রতক্ষ্যভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এমনকি বিসিএস পাস করে ক্যাডার সার্ভিসে যোগ না দিয়ে সাংবাদিতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল ছিলো দৈনিক জনকন্ঠ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন দৈনিক আর সাপ্তাহিকে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত লিখেছেন কলামের পর কলাম-অবিরাম। ১৯৪৭ সালের ২০ এপ্রিল সাতক্ষীরা শহরের এক অভিজাত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন সুনীল ব্যানার্জি।  ১৯৭২ সাল থেকে আমার বাবা প্রয়াত সুনীল ব্যানার্জি আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকতা পেশার সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। দীর্ঘ কয়েক দশকের সাংবাদিকতা পেশায় তিনি দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক বাংলা এবং দৈনিক জনকন্ঠে কাজ করেছেন। দেশের অবহেলিত জনপদ ও বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্টের আলোকে সুনীল ব্যানার্জি নামটি পাঠক মহলে হয়ে উঠে প্রশংসিত ও আলোচিত। বিসিএস পাশ করে পুলিশের চাকরিতে যোগ না দিয়ে সাংবাদিকতাকেই তিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তাছাড়াও তাঁর ছিলো এলএলবি ডিগ্রি। সুতরাং ক্রাইম রিপোর্টং এর ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা এবং পারিপার্শ্বিকতা ছিলো অতুলনীয়। নিজের প্রাণ বাজি রেখে তাঁর কলম চলেছে তীরের মতো তীক্ষ্ণ। পেশাগত দায়িত্ব পালনের বাইরেও বাবার পরিচিতি ছিলো ব্যাপক ও বিস্তৃত। তিনি ছিলেন একাধারে জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্থায়ী সদস্য, ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটের আজীবন সদস্য ও কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর কার্যনির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন।  অত্যন্ত সুদর্শন এবং সদালাপি বাবার ব্যক্তিত্ব বোধ সকলকেই খুব আকৃষ্ট করতো। হয়তো সে কারণেই যখনই যেখানে তাঁর সাথে গিয়েছি, পেয়েছি মানুষের ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! এখন আর কেউ আমাকে সহজে চিনতে চায় না। অপমান করতে এতোটুকু দ্বিধা বোধ করে না। হয়তো এরই নাম বাস্তবতা। এই নিষ্ঠুর আর নির্মম বাস্তবতা গুলো মেনে নিতে আমার বড় বেশি কষ্ট হয়। এই তীব্র কষ্টের যন্ত্রণায় বেঁচে থাকার স্বর্ণালী দিন গুলো আজ আমার কাছে অর্থহীন। নিজেকে বড় বেশি অসহায় লাগে। একা লাগে। এই একাকৃত্ত বোধ আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছাটুকুও গ্রাস করে নিচ্ছে…!

মানুষের কাছে আজ আমার আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। বাস্তবতার কষাঘাতে আজ আমি বড় বেশি ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। মোহাম্মদপুরের একটি জরাজীর্ণ ঝামেলা পূর্ণ বাড়িতে আমি আমার অসুস্থ মাকে নিয়ে বাস করি। বাবাকে অকালে হারিয়েছি বলেই মায়ের সুচিকিৎস্বার্থে বিদেশ যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। অর্থ জোগাড়ের আশার আকাশ-পাতাল দৌড় ঝাপ করেছি। প্রাপ্তির খাতায় অপমান ছাড়া কিছু জোটেনি। যতোদিন বেঁচে থাকবো, ততোদিন হয়তো এভাবেই অচেনা বিবর্ণ পথ গুলোকে পাড়ি দিতে হবে। দেখতে হবে মানুষের বহুরূপিতা। সহ্য করতে হবে তীব্র কষ্ট আর যন্ত্রণা। হতাশায় ভর করে পার করতে হবে জীবনের প্রতিটি মুর্হূত্ব, প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি দিন…!

আমি বলেছি, কিছু মানুষ-তাঁর পরিবার,তাঁর এলাকার সীমানা ছাড়িয়ে গোটা একটা দেশের জন্যে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁরা তাঁদের মেধা মনন আর চেতনার সমন্নয়ে জাতিকে আলোকিত করেন, আলোকিত করেন দেশকে। এরকম গুণী মানুষদের কদর করতে হয় ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয়,সকল পর্যায় থেকে। একক এবং সম্মিলিত ভাবে। নইলে কি হয়, তা তো জ্ঞাণতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেই গেছেন-যে দেশে গুণীর কদর হয় না সে দেশে গুণীরা জন্মায় না। আমরা কি আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কদর করি? সম্মান করি? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তরটি না সূচক। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্ম কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁদের পরিবারের সদস্যরাই কেবল স্মরণ করেন তাঁদের। দায়টা যেনো কেবল তাঁদেরই। আর কারো কোনই দায় নেই। এর জ্বলন্ত প্রমাণ আজ আমার সামনে উপস্থিত। লেখাটির শুরুতে আমি যাদের উদাহরণ দিয়েছি, তাদের প্রত্যেককে নিয়ে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখেছি। কিন্তু আমার বাবাকে নিয়ে একমাত্র নির্মল সেন ছাড়া কেউ কলম ধরেননি। আমি বাবার বন্ধু বরেষু অনেককে অনুরোধ করেছি, তাঁর স্মরণে কিছু লেখার জন্য। কোন লাভ হয়নি। ২০০৬ সালে একুশে গ্রন্থমেলায় বাবার শেষ লেখা বই ‘‘সাংবাদিকতায় বিড়ম্বনা’’ প্রকাশিত হয়। বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন, প্রয়াত বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান। তিনি সেখানে সুনীল ব্যানার্জিকে একজন আপাদমস্তক সাংবাদিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই আপাদমস্তক সাংবাদিকের নামটি-ই আজ বিলীন না হলেও মলিন হয়ে গেছে। সময়ের শ্রোত আর কালের পরিক্রমায় নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যাবে সুনীল ব্যানার্জির অসামান্য কৃত্তির পরিচয়। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক ছাড়া আর কি হতে পারে!

ভালোবাসার বহতার কথা বলেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুঁর। তিনি তাঁর পিতার শেষ অন্তোষ্টি ক্রিয়া সম্পন্নকালে বলেছিলেন, ‘‘তাহা (বাবা) আলোকের ন্যায়, সমিরণের ন্যায়, তাহা শিশুকাল হইতে আমাদিগকে নিয়ত রক্ষা করিয়াছে, কিন্তু তাহার মূল্য কেহ কখনো চাহে নাই…!’’ আজ প্রায় ছয়টি বছর পার হয়ে গেলো। বাবা আমাকে ‘খোকা’ বলে ডাকতেন। বাবার মুখে সেই প্রিয় ‘খোকা’ ডাকটি আর শুনি না। তাঁর মৃত্যুর সময় আমি চট্রগ্রামে মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত ছিলাম। বাবার আশা ছিলো আমাকে ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর আশারও ইতি ঘটেছে। নিয়তির এমনই নির্মম পরিহাস যে আমাকে এখন রাস্তায় রাস্তায় সস্তা সাংবাদিক হিসেবে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। একটি ভালো চাকরির জন্যও আমি কম ঘুরিনি। সম্প্রতি প্রযুক্তির প্রসারের উপকারিতায় ফেসবুকে আমার কিছু বন্ধুর আর্বিভাব ঘটেছে। যাদের অনেকেই আমি চিনি না।  আমার বিভিন্ন লেখার মন্তব্য তারা করেন। আমাকে শান্তনার বাণী শোনান। প্রকৃত সত্যিটি হচ্ছে, তারা কেউ আমাকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন না। মানুষের মনুষ্যত্ব বোধ কোন পর্যায়ে সেটি আমার আর নতুন করে বলার কিছু নেই। যাদের উপকার বাবা করে গেছেন আজ তারাই বাবার বিরুদ্ধে নানান কথা বলে বেড়ায়। প্রতিবাদ করি বা না করি, বিচিত্র কারণে আমিও তাদের বিরাগ ভাজন। কেন আমাকে এই পরিস্থিতে পড়তে হলো? কি পাপ আমার? জানি এর কোন উত্তর নেই। তারপরও এসব মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হয়, যেই কষ্ট বোঝার চেষ্টা কেউ করে না…!

পরিশেষে বলতে চাই, নীল বেদনার রং, নীল ভালোবাসার প্রতীক। আমার বাবার ‘‘সুনীল’’ নামটি যেন মানুষের মনে অম্লান ভালোবাসায় ভরে থাকে চিরদিন, চিরকাল…সেটাই এখন আমার একমাত্র প্রত্যাশা।

 

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ প্রয়াত সুনীল ব্যানার্জির পুত্র।।

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক