সুনীল ব্যানার্জিঃ নতুন প্রজন্মের কাছে আদর্শের মহান ব্যক্তিত্ব

সুনীল ব্যানার্জিঃ নতুন প্রজন্মের কাছে আদর্শের মহান ব্যক্তিত্ব

মোঃ ফরিদ আহম্মেদ: বেদনামাখা আগষ্ট মাসের ২৮ তারিখ। বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, গবেষক, বরেণ্য সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জির ৮ম প্রয়াণ দিবস। ২০০৬ সালে রাতের শেষ প্রহরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকষ্মিকভাবে কলম সৈনিক না ফেরার দেশে চলে গেলেন। কাঁদিয়ে গেলেন তাঁর আত্মীয়-স্বজন, ভক্ত পাঠক মহল এমন কি গোটা জাতিকে। অতি সাদামাটা জীবন যাপন করে এই অসাধারণ মানুষটি তাঁর প্রতিভার দ্যূতি, প্রজ্ঞা, কর্ম, জীবনাদর্শ, চিন্তা-ধারা ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন সাংবাদিকতার দর্শন ও গতিধারা। তাঁর ক্ষুরধার লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে সমাজের সহজ সরল বঞ্চিত মানুষের বাস্তবিক জীবন যাপনের চিত্র এবং অন্যদিকে ধনিক শ্রেণীর ভন্ডামি। তাঁর রুটিন মাফিক দিনাতিপাত হত বই পড়া, গবেষণা করা ও লেখালেখি করে। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বস্তুনিষ্ঠ ও দর্শন এবং গতিশীল করার প্রত্যয়ে সর্বদাই নৈতিকতার সাথে কাজ করে গিয়েছেন প্রয়াণের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত- যার গতিধারা সমাজ থেকে জাতি, জাতি থেকে রাষ্ট্র এমনকি বহির্বিশ্বে সাংবাদিক মহলে সমাদৃত। বলা যায় অনাদি অনন্তকাল পর্যন্ত সংবাদ মাধ্যম ও এ পেশার সকলকেই শিক্ষা নেয়ার জন্য একটি সাংবাদিকতার গবেষণাগার সৃষ্টি করে গিয়েছেন জনপ্রিয় সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জি।

অসাধারণ গুণী, যশস্বী সুনীল ব্যানার্জির পরিবারের সাথে আমার পরিচয় প্রায় এক যুগ হবে। সাতক্ষীরা শহরের এক অভিজাত পরিবারে ১৯৪৭ সালের ২০ এপ্রিল তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। বি.সি.এস পরীক্ষা পাশ করে ‘ক্যাডার সার্ভিস’এ যোগদান করেননি, এমন কি এল.এল.বি সম্পন্ন করে আইন পেশায় যোগদান না করে ‘সাংবাদিকতা’ বেছে নিয়েছিলেন। সুনীল ব্যানার্জি নিজেই তাঁর কর্ম, উচ্চকাঙ্খা ঠিক করে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং আত্মতৃপ্তি পান। সুনীল ব্যানার্জি ছিলেন তেমনি একজন মানুষ, যাঁর ছিল চমৎকার ব্যক্তিত্ব। সহজেই আকর্ষণ করে। প্রকাশভঙ্গি ছিল একেবারে সহজ। তাঁর কর্মজীবনে কাজের বৈচিত্র্য ছিল, সবটুকু এত স্বল্প পরিসরে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যশস্বী সুনীল বানার্জি যেমন ছিলেন নিরহঙ্কার সাদাসিধে মানুষ, তেমিন ছিলেন অসাধারণ বিনয়ী। পদলোভ, খ্যাতিলোভ কোনটাই তাঁর ছিল না। মানুষ হিসেবেও ছিলেন অতি উঁচু মাপের। কবি শামসুর রাহমান সহ গুনী কবি সাহিত্যিকদের সাথে ছিল তাঁর গভীর সম্পর্ক। তিনি পেশাগত কাজের ফাঁকেও বিবিধ বিষয়ে লেখালেখি করতেন। সুনীল ব্যানার্জির রচিত ‘সাংবাদিকতার বিড়ম্বনা’ বইটি ২০০৬ সালে একুশে বই মেলায় ব্যাপক সাড়া পায় এবং পাঠক মহলকে আকৃষ্ট করে। আমি অকপটে বলতে পারি- কটু বাক্য, ঝগড়া-ঝাটি, খারাপ আচারণ, মানুষ ঠকানো, ঘুষ-দূর্ণীতি, পরনিন্দাসহ সকল প্রকার রিপুর তাড়নামুক্ত ছিলেন প্রয়াত এই নন্দিত ও সাহসী সাংবাদিক। শাসক মহলের বাঘা বাঘা রাগব-বোয়াল কিংবা কোন স্বার্থান্বেষী শ্রেণির মানুষের উষ্কানী ও হুমকি ধামকির পাত্তা না দিয়ে আপোষহীন ভাবে সত্যের উৎঘাটন করে সহজ সরল ভাষায় জনগণের মাঝে রিপোর্ট প্রকাশ করতেন। সাংবাদিক পেশায় নৈতিকতার যে স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন, তার তুলনা কেবল তিনি নিজেই। জন জীবনের পারিপার্শ্বিকতা ভেবেচিন্তে যেমন প্রাসঙ্গিক খবর তুলে ধরতেন, তেমনি তিনি সব অসুন্দরকে ভেঙ্গে চুরমার করে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন। যে সৃষ্টির পথ অসুস্থ নয়। সুস্থ পথের পথিকৃত সুনীল ব্যানার্জি নতুন প্রজন্মের কাছে আদর্শের মহান ব্যক্তিত্ব-বলা অতিকায় রঞ্জিত হবে না বলে আমি মনি করি। মৃত্যু সকলের জন্য অবধারিত। কেউ আগে, কেউবা পরে মৃত্যুর স্বাদ অবশ্যই গ্রহণ করবে এটা চিরন্তন সত্য। আর এটাও সত্য যে, সুনীল ব্যানার্জিকে ‘মৃত্যু’ জীবিতের সম্মান দিয়েছে, মৃত্যুও সম্মানিত হয়েছে। মৃত্যু তাঁকে পরাজিত করতে পারেনি বরং আমাদের ভীড়ে তাঁকে, স্মরনীয় ও বরণীয় করে রেখেছে। তিনি তাঁর কর্ম ও প্রতিভার দ্যূতিতে আলোকিত হয়ে আছেন। থাকবেন অনাদিকাল।

প্রসঙ্গত, জনপ্রিয় প্রয়াত সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জি প্রয়াণের আগে জনকন্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত অধুনালিপ্ত দৈনিক বাংলার সিনিয়র রিপোটার্স ছিলেন। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্থায়ী সদস্য এবং ঢাকা  রিপোটার্স ইউনিটের আজীবন সদস্য ছিলেন। তাঁর দীর্ঘ কর্ম জীবনে আদর্শ ও যোগ্যতার গুনে ২০১০ সালে মরোনত্তর পুরস্কার লাভ করেন। ৫৯ বছর জীবনকালে রেখে গেছেন তাঁর কত শত স্মৃতি! তাঁর সহধর্মিনী শিখা ব্যানার্জি কৃষি ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র অফিসার এবং একমাত্র সন্তান শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ একটি পত্রিকার সম্পাদক। কীর্তিমান এই সাংবাদিকের মোহাম্মদপুরস্থ বাড়ীতে কর্ম জীবনের স্মৃতিগুলো আজ যেন মলিন। স্মৃতির আলোয় তিনি বেঁচে থাকুন সকলের তরে। পরিশেষে যা না বলেই শেষ করতে পারছিনা-
‘মৃত্যু যাকে স্বর্গ দিয়েছে, করেছে জীবিতের সম্মান,
অমর তিনি স্মরনীয় তিনি, সবকিছুই তাঁরই অবদান।’

[মোঃ ফরিদ আহম্মেদ: শিক্ষক]
০১৭১২-১৫৩৬২৮.
ই-মেইল: rosemoni1421@gmail.com

অতিথি লেখক