জেনেশুনেই কি বিষ করেছি পান!

জেনেশুনেই কি বিষ করেছি পান!

>

প্রণব মজুমদারঃ

শেষ পর্যন্ত বাকী ছিলো ডিমে ভেজাল মেশানোর। রঙে রাঙিয়ে ক্রেতাকে বোকা বানানো হচ্ছে। বিক্রেতার প্রতারণার অভিনব কৌশলে ক্রেতা কিনছেন অপেক্ষাকৃত দামি দেশী ডিম। আসলে তা হচ্ছে ফার্ম বা পাকিসত্মানি ডিম। একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকের বিশেষ আয়োজন মহানগরবাসির সাপ্তাহিক সম্ভারে এমন খবরে রীতিমতো স্ত্রীর চোখও ছানাবড়া। স্ত্রী ও কন্যার পচ্ছন্দ দেশী মুরগীর ডিম। সকাল বেলায় পত্রিকা হাতে নিয়ে চায়ের পেয়ালায় চুমক দিয়েই স্ত্রীর প্রশ্ন তাহলে এদ্দিন পাকিসত্মানি ও ফার্মের ডিম খেয়েছি ? ডিম খেতে কন্যার অনীহা জন্মাবে ভেবে স্ত্রীর কথামতো ঢাকায় থাকি’র পৃষ্ঠা লুকিয়ে রেখেছি সেদিন।

গিন্নির প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি বলে নিরব থেকেছি। কেননা, আরও দশজনের মতো আমিতো একজন অসহায় ভোক্তা। একজন সাংবাদিক হিসেবে তাদের প্রতিনিধি হয়ে প্রতিকারের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বিরাজমান ভেজাল ও জালিয়াতি নিয়ে দু’কলম লিখতে পারি মাত্র।

আমার মতো দৈনিক বাজারে যাওয়া নিম্ন মধ্যবিত্তের সদস্যরা বেশ অসহায়। ক্রমবর্ধমান বাজারে অতিরিক্ত মূল্য দিয়েও নির্ভেজাল জিনিষ পাওয়া আজকাল দুস্প্রাপ্যই বলা যায়। শিশু বেলায় শুনতাম দুধে জল মেশানো হয়। চাকচিক্য ও চাহিদাহীন সমাজের পণ্য বাজারে তখন ভেজাল বলতে ছিলো ওটুকুই।

সমাজের জৌলুস ও চাকচিক্য বেড়েছে। আকাশছোঁয়া চাহিদার ক্রমবর্ধমান বর্তমান শিক্ষাত সমাজে শুধু খাদ্যপণ্য নয় সকল কিছুইতে ভেজাল, জালিয়াতি ও প্রতারণার যত অভিনব কৌশল। ফরমালিনের গন্ধে এখন মাছের বাজারে মাছি দেখা যায় না। দেশী মোরগ বা মুরগী বলে বিক্রি হচ্ছে পাকিসত্মানি মাল। সবজি টাটকা রাখার জন্য এক ধরনের রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলের বাজারে কেমিক্যালের ঝাঁজে কেনা ফল বাড়িতে বেশী সময় সংরক্ষাণ করা যায় না। বর্তমান দুস্প্রাপ্য পণ্য চিনিতে ইউরিয়া সার মেশানো হয়। ওজন বৃদ্ধির জন্য অাঁখের গুড়ে আজকাল আটা ও বালু যোগ করা হচ্ছে। গাজীপুরের ইউরিয়া সার মিশ্রিত ভাজা মুড়ি ঢাকাবাসীর কাছে এখনতো আর চমকপদ খবর নয়। সাধারণ চালে কাঁকড় ও ছোট ছোট পাথর ও ইটের টুকরো মেশানোতো থাকেই। মিনিকেট ও জিরা নাজির চালের চাকচিক্য বাড়ানোর সাদা রঙের প্রলেপ দেয়া হচ্ছে। প্যাকেটজাত হলুদ ও মরিচে মেশানো হয় আটার গুঁড়া। এতো গেলো ভেজালে একাকার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের কিছু ফিরিসিত্ম।

বাজারে গেলে চোখে পড়বে সবজি বিক্রেতাদের ওজনচুরির বিস্ময়কর কারসাজি। পালস্না ঠিক নেই। ৫০ বা ১০০ গ্রামের বাটখারার বিকল্প হচ্ছে পাথর। এ বাজারে বেশিরভাগ বিক্রেতার কাছেই বিএসটিআই অনুমোদিত উমাচরণ কর্মকারের পালস্না নেই। ব্যবসায়ে পালস্না তারা নিজের মতো করে তৈরি করে। একজনের বাটখারা অন্যজনের বাটখারার সঙ্গে সমান হয় না। ফলের দোকানে ১০০/১৫০ ওজনের ভারি ঠোঙ্গা দিয়ে পণ্য পরিমাপ করা হয়। সচেতন ক্রেতা এর প্রতিবাদ করলে তার কাছে বিক্রেতা জিনিষ বিক্রি করতে চান না। কখনও কখনও ক্রেতাকে ভৎসনাও সইতে হয়। ১০০ লিচুর দাম দিয়ে বাড়ি ফিরে গণনা করে ১০০ পেয়েছেন এমন ক্রেতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মহানগর জীবনে গত ২০ বছরে লিচু কিনে আমি সফল হইনি। ওজনে দ্রব্য কম দেয়ার জন্য আজকাল শুটকির দোকানে দেখা যাচ্ছে পলিব্যাগের সঙ্গে ট্রেসিং পেপার ব্যবহৃত হচ্ছে। ১০/১২টি ট্রেসিং পেপার মুড়িয়ে শুটকি পরিমাপ করা হয়। এ ব্যাপারে দোকানির বক্তব্য হচ্ছে শুটকি মাছের গন্ধ অনেকের কাছে অসহনীয় এবং মাছের তৈল অপরের গায়ে যাতে স্পর্শ করতে না পারে তাই এ সুরক্ষা।

এবার আসা যাক মূল্যের ক্ষেত্রে। এখানেও প্রতারণা আর জালিয়াতির খেলা। একই বাজারে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে মুদি পণ্যমূল্যের রকমফেরের কথা না হয় বাদই দিলাম। নিত্য ব্যবহার্য্য পণ্য যেমন সাবান, নারকেল তৈল, শ্যাম্পু, টুথপেষ্ট, ব্রাশ, লোশন, বাল্ব, জেলি, সস, রম্নটি, চা পাতা, মশার কয়েল ইত্যাদির দাম দোকান ভেদে একক রকম। ব্র্যান্ড আইটেমের ক্ষেত্রেও মূল্য পার্থক্যের এ অবস্থা বিদ্যমান। বেশি দামে পণ্য বিক্রির আশায় দোকানি পণ্যের মোড়কে লেখাটি ঘষে তুলে ফেলে। সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ও উৎপাদন এবং মেয়াদের তারিখ অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ির কাছে তাই অর্থহীন।

খাদ্যে ভেজাল, পণ্যে ভেজাল, সেবায় ভেজাল, শিক্ষায় ভেজাল, চিকিৎসায় ভেজাল সর্বোপরি রাজনীতিতেও ভেজাল। বাকি রইলো কি ? বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ভোগ্যপণ্যের বাজার সুরক্ষায় সরকারিভাবে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিলো। বাজার থেকে অনেকটা মুক্ত হয়েছিলো এ অনাচার এবং অপরাধ। বর্তমান সরকারের আমলে জাতীয় ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষাণ বিভাগ খোলা হয়েছে। যদিও এর পরিধি এখন ছোট। তারপরও বলবো দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ কোনো সরকারের দ্বারা যখন সম্ভব হচ্ছে না তখন ক্রেতাদের স্বাস্থ্য রক্ষা এবং প্রতারণা ও জালিয়াতির হাত থেকেতো মুক্ত করা যায়। ফি বছর যেখানে দেড় লাখ কোটি টাকার ওপরে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করা হয় সেখানে ভোক্তার খাদ্য নিরাপত্তায় বিষয়টিকে কি অধিক গুরম্নত্ব দেয়া যায় না ? মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়া অধিক মুনাফালোভি ব্যবসায়ির নিত্য আহার পণ্যের সঙ্গে বিষ প্রয়োগ এবং তাদের জালিয়াতি এবং প্রতারণা রোধের দায়িত্বতো সরকারেরই। সরকারের প্রশাসন এবং সংশিস্নষ্ট বিভাগ যদি বলে আমরা অপারগ। তাহলে কি আমরা অসহায় ভোক্তারা জেনেশুনেই বিষপান করে যাবো ?

 লেখক অর্থনীতি ও পররাষ্ট্র বিষয়ের বিশেস্নষক

reporterpranab@gmail.com

editor

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।