গান পাউডারের ইতিবৃত্ত এবং একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট

গান পাউডারের ইতিবৃত্ত এবং একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট

সন্তোষ মন্ডল :
রাজনৈতিক সহিংসতায় গান পাউডারের ব্যবহার উদ্বেগজনকহারে বেড়ে যাওয়ায় শঙ্কিত খোদ পুলিশ প্রশাসন। বিষয়টি সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শাহবাগ এলাকায় গান পাউডার দিয়ে একটি যাত্রীবাহী বাসের ২৫ যাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় হতবাক হয়ে গেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ দেশবাসী। অবশ্য এমন ঘটনা ঘটতে পারে- আশংকা ব্যক্ত করে এবং গান পাউডারের অপব্যবহারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি সরকারের কাছে যে রিপোর্ট পেশ করেছে, তাতে আরও ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত একমাসে যশোর এবং রাজশাহী সীমান্ত এলাকা থেকেই গান পাউডার উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১০০ কেজি। এই পাউডার দিয়ে সবগুলো মেট্টোপলিটন সিটি পুড়িয়ে দেয়া সম্ভব বলে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়। ধরা পড়ার বাইরেও আরও যে কি পরিমান গান পাউডার দেশে ঢুকেছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য গোয়েন্দা সংস্থাটি দিতে পারেনি। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী গত ২৭ অক্টোবর যশোরের শার্শা থানার মহিশাকুড়া গ্রাম থেকে একটি ওয়ান শুটারগান ও ৮টি শক্তিশালী হাত বোমাসহ বিপুল পরিমান গান পাউডার ও বোমা তৈরীর সরঞ্জামাদি উদ্ধার করেন র‌্যাব-৬ এর সদস্যরা। একই দিন পুলিশ আজিমপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের কোয়ার্টার থেকে ১৭টি হাতবোমা ও আধা কেজি গান পাউডার উদ্ধার করে। যে পরিমাণ গান পাউডার পাওয়া গেছে, তা দিয়ে এক হাজারেরও বেশি হাতাবোমা তৈরি করা সম্ভব বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এর দু’দিন পর বেনাপোল পোর্ট থানা পুলিশ এক কেজি গান পাউডারসহ সাদ্দাম হোসেন ও জাহিদুল ইসলাম নামে দু’জনকে আটক করে। এ ছাড়া গত ৯ নভেম্বর রাজশাহীর পবার উপজেলার একটি গ্রাম থেকে সাড়ে ৪ কেজি গান পাউডার ও ২৬টি তাজা ককটেল পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেন র‌্যাব সদস্যরা। দু’দিন পর ১১ নভেম্বর রাজধানীর আজিমপুর থেকে অর্ধশতাধিক অবিস্ফোরিত ককটেল, গান পাউডার ও একশোর মত গুলতি উদ্ধার করে লালবাগ থানা পুলিশ। গত ১৫ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার দর্শনা তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিত্বে অভিযান চালিয়ে দর্শনার পরাণপুর গ্রামের মাঠ থেকে লাল টেপ জড়ানো শক্তিশালী দুটি তাজা বোমা ও প্রায় ৩০০ গ্রাম গান পাউডার এবং বোম তৈরির আরো কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করে। এছাড়া ১৭ নভেম্বর মিরপুর ১১ নম্বরের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ৩ টি বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ বিপুল পরিমান গান পাউডার উদ্ধার করেছে পুলিশ। এসময় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এরকম আরও কিছু ভয়াবহ বিস্ফোরকদ্রব্য উদ্ধারের ঘটনা উল্লেখ করে গোয়েন্দা রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, ২৫ নভেম্বর রাতে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ দীপকেন্দ্র নাথ দাসের বাসভবনে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের সময়ে গান পাউডার ব্যবহার করা হয়েছে। এতে ছাত্র শিবির সরাসরি জড়িত বলেও ঐ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। কারণ আজিজুল হক কলেজে যোগদানের আগে দীপকেন্দ্র নাথ দাস রংপুর কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তখন ওই কলেজ ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নিজে বাদী হয়ে দুটি মামলা করেন। এজন্যে শিবির প্রতিশোধ নিতে গান পাউডার দিয়ে অধ্যক্ষের বাস ভবনটি জ্বালিয়ে দেয়। এই হামলা ও অগ্নি সংযোগের সঙ্গে ছাত্রশিবির ছাড়াও ছাত্রদলের সম্পৃক্ততা ছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্র মতে, দেশে গান পাউডারের ভয়াবহ ব্যবহার শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। ওই বছরের ২৯ মে শিবির ক্যাডাররা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ টি আবাসিক হল গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। দেশের ইতিহাসের এই আলোচিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক উমার আলীর। জামায়াতপহ্নী এই শিক্ষক তার ল্যাবরেটরি থেকে গান পাউডার সংগ্রহ করেন বলে তখন তদন্তে প্রমাণ হয়। এরপর দেশে যতগুলো গান পাউডার সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতার অনেক প্রমাণ আছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। চলতি সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় যে গান পাউডার ব্যবহার করা হচ্ছে তার সঙ্গেও শিবির ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানো হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপুল পরিমান গান পাউডার আসছে কোথা থেকে? ঢাকায় একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ রাইজিংবিডিকে বলেন, গান পাউডার দেশে আমদানি হয় বৈধ-অবৈধ দু’ভাবেই। তবে সহিংসতায় ব্যবহৃত গান পাউডারের সিংহভাগ আসে চোরাচালানের মাধ্যমে সীমান্তের ওপার থেকে। গান পাউডার কি-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, গান পাউডার কোনো একক ইউনিট নয়। মোট চারটি কেমিক্যাল কমপোনেন্ট মিলিয়ে তৈরি করা হয় গান পাউডার। এই চারটি কেমিক্যাল হচ্ছে- পটাশিয়াম ফ্লোরেড, পটাশিয়াম নাইট্রেড, সালফার এবং চরকোল (কাঠ কয়লা)। এই চারটি উপাদানের সবগুলোই দাহ্য পদার্থ। এগুলো একসাথে হলে দহনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ফলে যেকোন অবস্থায় গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরালে মুহুর্তেই সব কিছু পুড়িয়ে ফেলা সম্ভব। বৈধভাবে যারা এসব কেমিক্যাল ব্যবহার করেন, তাদের লাইসেন্স নিতে হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে। জেলা প্রশাসন ১৮৭৮ সালের আর্মস এন্ড এ্যামুনেশন এ্যাক্ট-এর আওতায় এর লাইসেন্স প্রদান করে এবং একই আইন বলে জেলা প্রশাসকের দপ্তর এর ব্যবহার, বহন, গুদমজাত মনিটরিং করে থাকে।

কিন্তু অবৈধভাবে আমদানি ও ব্যবহারকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্ভব হয়না। শুধুমাত্র ধরা পড়ার পর পুলিশ কিছু আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। কিন্তু এমন একটা ভয়াবহ অপরাধের বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ তা সম্ভব হয়না। আইনের ফাঁক-ফোঁকড় দিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।

[লেখক: সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মী।]
{সৌজন্যে: রাইজিংবিডি.কম}

অতিথি লেখক