রামপাল নিয়ে ‘অপপ্রচার’ হয়েছে! ‘প্রচার’ হয়নি কেন?

রামপাল নিয়ে ‘অপপ্রচার’ হয়েছে! ‘প্রচার’ হয়নি কেন?

শওগাত আলী সাগর:

‘বিরোধীতা করার অধিকার আছে,সমর্থন করারও অধিকার আছে।‘- সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকে সাংবাদিক ইশতিয়াক রেজার স্ট্যাটাস এটি। তার পরের লাইনটি তিনি লিখেছেন,’আমি রামপাল পাওয়ার প্লান্ট চাই।‘ ইশতিয়াক রেজার স্ট্যাটাসের প্রথমাংশটুকু সার্বজনীন বলে আমি নিজে মনে করি। দ্বিতীয় অংশটুকু তার নিজের এবং হয়তো আরো অনেকের।সরকারের তো বটেই।

ইশতিয়াক রেজা রামপালে কেন পাওয়ার প্লান্ট চান,তার পক্ষে নিশ্চয়ই তার  যুক্তি আছে। সেই যুক্তি তার কাছ থেকে আমরা শুনতে চাইতে পারি। কিন্তু ‘রামপাল পাওয়ার প্লান্ট’ চাওয়ার তার যে  অধিকার,সেই অধিকারের বিরোধীতা করতে পারি না। একইভাবে যারা রামপালে পাওয়ার প্ল্যান্ট চান না,তাদের  ‘রামপালে পাওয়ার  প্ল্যান্ট’ বিরোধীতার কারন জানতে চাইতে পারি,কিন্তু তাদের নাকচ করে দিতে পারি না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে,আমরা কোনো আলোচনা করতে চাচ্ছি না, কারো কথা শুনতে চাচ্ছি না। বরং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে  প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। সেই উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় কোনো যুক্তি তর্কের খেলা তেমন একটা নেই। তথ্য উপাত্ত তুলে ধরার প্রবনতাও নেই। বরং খেলো,ক্ষেত্র বিশেষে আপত্তিকর শব্দমালা,উপমা দিয়ে আমরা প্রতপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছি।

ফেসবুকে কোথাও কোথাও যে যুক্তি তর্ক হচ্ছে না, তাও নয়। তবে সেটা সামান্য। অনলাইন জগতের তারকা ব্যক্তিরা যুক্তির চেয়ে ‘কুযুক্তি’ দিয়ে নানা রকম তকমা লাগিয়ে বাক্যের মালা গাথছেন। কেউ কেউ আবার ‘বাবা তুলে’  কোন প্রাণীর বাচ্চা তাও  জানান দিচ্ছেন। কিন্তু এইগুলো যে তাদের পক্ষের গ্রহনযোগ্যতা বাড়ায় না সেটা বোধ হয় তারা বুঝতে চাচ্ছেন না। ফেসবুকের ‘ভার্চ্যুয়াল জগত’ আর মাটি-কাদার বাস্তব জগত যে ভিন্ন সেটা আমরা অনেকেই মনে রাখতে পারছি না।

বাস্তবজগতে ‘বামপন্থীরা’ রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নিয়ে একটা নাড়া দিতে পেরেছে বলেই মনে হচ্ছে। অন্তত সরকার যখন প্রেসনোট জারি করে ফেলেছে তখন বুঝতেই হয় ঘটনা অনেক দূর গড়িয়েছে। প্রেসনোটে  অবশ্য দাবি করা হয়েছে ‘রামপাল’ নিয়ে অপপ্রচার’ হচ্ছে। আমার প্রশ্ন রামপাল নিয়ে কোনো ‘প্রচার’ হলো না কেন?

সরকার যখন কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেয় তখন  তার একটি সম্ভ্যাব্য যাচাই করে নেয়। সেই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যেমন থাকে,পরিবেশগত সম্ভাব্যতার ব্যাপারটিও থাকে। আর সুন্দরবনের পাশে একটি  বিদ্যুৎকেন্দ্র- স্পর্শকাতরতার সম্ভাব্যতাও যাচাই করা জরুরী হয়ে পড়ে। এগুলো হচ্ছে পুরনো নিয়ম। কিন্তু অধুনা পশ্চিমা-শিল্পোন্নত বিশ্ব বিষয়টাকে আরো একটু গনমুখী করে ফেলেছে। কোনো প্রকল্প হাতে নিয়েই কানাডাসহ পশ্চিমের অনেকদেশই নানা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মাসের পর মাস ধরে আলোচনা করে, বিতর্ক করে। এই কানাডায় দেখেছি নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাবনা নিয়ে গণশুনানী করতে। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাধারন নাগরিকদের ডেকে নিয়ে তাদের মতামত শোনা হয় গণশুনানীতে। বাংলাদেশে কখনোই কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ঘটেনি বলে ঘটনো যাবে না, তাও তো নয়।

যারা রামপালে পাওয়ার প্ল্যান্ট এর বিরোধী তারা কিন্তু দিনের পর দিন তাদের বক্তব্য প্রচার করেছেন।কিন্তু সরকার কতোটা প্রচার করেছে? প্রধানমন্ত্রী কতোদিন তার বক্তৃতায় রামপালের উদ্দেশ্য এবং উপযোগীতার কথা জনগনকে বলেছেন? সরকারের অন্যকোনো মন্ত্রী? আওয়ামীলীগের নেতারা? বিদ্যুৎ উন্নয়নবোর্ডের কোনো এক পরিচালক বা সহকারি পরিচালক কোনো পত্রিকায় এক আধটা নিবন্ধ লিখেছেন,তাতেই এই প্রকল্পের ব্যাখ্যার কাজ সারা? আর এই প্রকল্পটার সঙ্গে সুন্দরবনের মতো আবেগপ্রবন এবং স্পর্শকাতর বিষয় সম্পৃক্ত বলেইতো সরকারের এই প্রকল্প নিয়ে আরো বেশি প্রচারনা চালানো উচিত ছিলো। কিন্তু সেটি করা ক্ষেত্রে  সরকারের প্রচারযন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে।

সন্দেহ নেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ইস্যূতে পরিণত হয়েছে। ‘তারকাখ্যাতি’সম্পন্ন অনলাইন এক্টিভিষ্টদের ‘বমাপন্থীদের’ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেওয়া পোষ্ট আর বক্তব্য সরকারকে রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী করবে না- এই বোধটা যদি সরকারের হয় তাহলে সেটা হবে  মঙ্গলের।

‘বামপন্থীদের’(আমি সচেতনভাবেই এই শব্দটা ব্যবহার করলাম। কারন লংমার্চওয়ালারা এই তকমায়ই চিহ্নিত হয়ে গেছেন ইতিমধ্যে) লংমার্চ থেকে ঘোষনা দেওয়া হয়েছে রামপালে পাওয়ার প্ল্যান্ট তারা করতে দেবেন না। এই ঘোষনা কতোটা বাস্তবায়নযোগ্য সেটা নিয়ে আপাতত কোনো মন্তব্য করলাম না। কারন তারা আন্দোলন করছেন এমন একটি সরকারের বিরুদ্ধে,যে সরকারের পুলিশ জামাত শিবিরের পুঁচকে ছোড়াদের হাতেও দাড়িয়ে দাড়িয়ে মার খায়,আত্মরক্ষার কথাও ভুলে যায়। কিন্তু শিক্ষক বা বাম তকমারীদের পিটিয়ে একশেষ করে দেয়। এখন পর্যন্ত লংমার্চকে ঘিরে সেই ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেনি। প্রত্যাশা করবো শেষ পর্যন্ত এই ধরনের কোনো ‘দুর্ঘটনা’ ঘটবে না। সরকার তার পুলিশ এবং অতিউৎসাহী রাজনৈতিক ‘অ্যাক্টিভিষ্টদের’ লংমার্চের আশপাশ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন-এটাই সবার প্রত্যাশা।

আর একটা কথা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জনমতের দিকেও যদি কোনো সরকার  মনোযোগ দেয়,তাতে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়ে বই কমে না। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে গোয়ার্তুমি না করে,লোক দেখানো ভিত্তি প্রস্থর স্থাপনের জেদ না ধরে,বরং আলোচনা,বিতর্কের সূচনা করা হউক। বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট,নথিপত্র জাতির সামনে উপস্থাপন করা হউক। জনগনকে ‘ইনফর্মড’ সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হউক রামপালের ব্যাপারে।

আবারো বলি, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে ‘প্রচারণায়’ সরকার অনেক পিছিয়ে আছে। জেদাজেদি সরকারকে আরো পেছনের দিকেই নিয়ে যাবে। উন্মুক্ত বিতর্কের সূচনা করে সরকার অন্তত সমান জায়গায় এসে দাড়াতে পারে। যুক্তি তর্ক শোনে জনগনই সিদ্ধান্ত নিক না।

[লেখক: শওগাত আলী সাগর,প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক,নতুনদেশ ডটকম]

অতিথি লেখক