উত্তরসূরী-পূর্বসূরীর রাজনীতিকে ‘না’ বলা শুরু

উত্তরসূরী-পূর্বসূরীর রাজনীতিকে ‘না’ বলা শুরু

মোমিন মেহেদী:
এই দেশ স্বাধীনতার স্বপক্ষে। এই দেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বপক্ষে। আর তাই রবী ঠাকুরের ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’ কে বুকে ধারন করে এগিয়ে চলেছে নিরন্তর। এই এগিয়ে চলার পথে তারা রাজনীতিকদের ভালো-মন্দের জবাব বারবার দিয়েছে ব্যালটের মাধ্যমে। কখনো কখনো স্বাধীনতার স্বপক্ষের রাজনীতিকদের দুর্নীতি-সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজীতে এতটাই অতিষ্ঠ হয়েছেন যে, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির-বিএনপিকে পর্যন্ত ক্ষমতায় বসিয়েছেন। এই সব কিছুই তারা করেছেন নিজেদের দেশকে দুর্নীতিবাজ-সন্ত্রাসী আর চাঁদাবাজদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য। আমি বলবো না যে, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির-বিএনপিকে  ক্ষমতায় বসিয়ে তারা ভালো করেছেন; তবে ব্যালটের মাধ্যমে স্বাধীনতার কথা বলে রাজনীতি করা এই তথাকথিত স্বাধীনতার ধ্বজাধারিদেরকে যথাযথ জবাব অন্তত দিয়েছেন।
এবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে বলেছিলো, ক্ষমতায় আসলে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে, স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের গ্রেফতার ও বিচার হবে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হবে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে, জনগনের জন্য অন্তত ভাত ও ডালের দাম সাধ্যের মধ্যে রাখা হবে এবং দুর্নীতিমুক্ত-চাঁদাবাজমুক্ত-সন্ত্রাসমুক্ত দেশ গড়া হবে।
কিন্তু তারা কথা রাখেন নি। কথা রাখেন নি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। বঞ্চিত করেছেন মহাজোট সরকারের প্রধান শরীক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে। বঞ্চিত করেছেন মহাজোটের অসংখ্য নেতাকর্মীকে। যে কারনে বঞ্চিত নেতাকর্মীরা অনিচ্ছা সত্বেও ঝুঁকেছেন দুর্নীতিতে। বিশেষ করে রাজনীতিতে প্রবীণ মানুষ রাশেদ খান মেনন, দীলিপ বড়–য়াসহ মহাজোটের শরীক অনেকেই। একে তো দুর্নীতি বেড়েছে, অন্যদিকে সন্ত্রাস। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর প্রায় প্রতিদিন-ই ঘটেছে হত্যা-হামলার ঘটনা। এমন কি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, সেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগসহ আওয়ামী লীগের সবগুলো অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা নিজেরাই খুন করেছে নিজেদের নেতাকর্মীকে। যার অধিকাংশই চাঁদার টাকা ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে। কিছুদিন আগে যুবলীগ নেতা রিয়াজুল খান মিল্কীকে হত্যা করা হয়। হত্যা করে যুবলীগের-ই আরেক গ্রুপের নেতারা। যাদের নির্দেশে এই খুন সংগঠিত হয়েছিলো, তারা যখন দেখলো ঘটনা জানাজানি হয়ে যেতে পারে; তখন প্রশাসনের মাধ্যমে ক্রশ ফায়ারের নামে খুন করা হয় মিল্কীর খুনী দুই যুবলীগ নেতাকেও। পরে এক নারীকে ফাঁসিয়ে দিয়ে তাকে গ্রেফতার করে এখন সেই মামলাটিকেই গায়েব করে দেয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
দুর্নীতি-চাঁদাবাজীর সাথে সাথে খুনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। সন্ত্রাসী লালনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় আসার জন্য নিরন্তর যে চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টার প্রাথমিক বাহিনী হলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রাথমিক বাহিনী এতটাই সন্ত্রাস আক্রান্ত যে, রাজপথে শত শত মানুষের সামনে মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে সংখ্যালঘু পরিবারের একজন যুবককে কুপিয়ে নির্মমভাবে খুন করে। আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও তারা গড়িমসি করছে; নিষিদ্ধ করতেও দেরি করছে ছাত্রশিবির-জামায়াতকে। কেননা, ছিয়ানব্বইর মত আবারো সখ্যতা তৈরি করতে চায় আওয়ামী লীগ জামায়াতের সাথে। তারা ক্ষমতা চায়; স্বাধীনতা নয়। যদি তাই না হবে; তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মাত্র ১ বছরে যখন এতদূর এগিয়ে যেতে পারে; সেখানে আগে সাড়ে ৩ বছর বসে ছিলো কেন? নিশ্চয়-ই ক্ষমতায় আসার স্বপ্নে বিভোর থাকার কারনে। সে যাই হোক, কখনো- কোন কারনে নতুন প্রজন্ম যদি একবার মুখ ফিরিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ নামক এই স্বাধীনতার পক্ষের সংগঠন থেকে; তখন যতটা ক্ষতি হবে দেশের মানুষের; ততটাই ক্ষতি হবে দেশের। আর একারনেই এখনই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সাথে সাথে দ্রব্যমূল্য হাতের নাগালে নিয়ে আসতে হবে বাকি ২ মাসের মধ্যেই। তা না হলে নির্দলীয়-ই শুধু নয়; স্বদলীয় সরকারের তত্বাবধায়নে নির্বাচন দিলেও পরাজয় ঠেকানো যাবে না।
আওয়ামী লীগ হয়তো খেয়াল-ই করেনি যে, ভোটারদের গুডলিস্টে না থাকা জন প্রতিনিধিদের সংখ্যা একশর অধিক তবে এর মধ্যে একশ জনের অবস্থা খুবই নাজুক। তাদের বেশিরভাগই আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন না। আবার যারা মনোনয়ন পাবেন তাদের পক্ষে নির্বাচনে জয় কঠিন হবে। ভোটারদের সুনজরে নেই আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ শতাধিক সাংসদ। এদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপকর্মের পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকান্ডে জনবিচ্ছিন্ন থাকার অভিযোগ রয়েছে। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাদের বাদ দিয়েই প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার দাবি জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বলছে, মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে দলের বিতর্কিত ও সমালোচিত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-সাংসদকে বাদ দেয়া হলে প্রার্থী সঙ্কটে পড়বে আওয়ামী লীগ। এ সুযোগে বিরোধী শিবিরে ভোটের পাল্লা ভারি হবে। তাই অনেকটা নিরুপায় হয়েই এদের একটি বড় অংশকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেবে। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বিতর্কিত হলেও তারা মনোনয়ন পাবেন।
যদিও দলের প্রথম সারির একজন নেতার দাবি, প্রার্থী নির্বাচনের দায়িত্ব দলীয় সভানেত্রী তৃণমূল নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তাদের বিচারে অযোগ্য কাউকেই মনোনয়ন দেয়া হবে না। তবে চূড়ান্ত তালিকা তৈরির আগে উত্থাপিত সব অভিযোগসহ সার্বিক বিষয়াদি দলের কেন্দ্র থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা হবে। বিশেষ করে যেসব আসনে যোগ্য বিকল্প প্রার্থীর সঙ্কট রয়েছে সেখানে স্থানীয় নেতাকর্মী ও জনগণের সঙ্গে সৃষ্ট দূরত্ব দ্রুত ঘুচিয়ে আনার চেষ্টা চালাবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হকের আসনকে পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর আসনকেও আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য প্রতিকূল হিসেবে চিহ্নিত । ফরিদপুর-২ (নগরকান্দা-সালথা) আসনে আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মী বিরূপ হয়ে আছেন বলে মাঠপর্যায় থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়ার বিরুদ্ধে নেতিবাচক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।  তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদের অবস্থানও নির্বাচনী এলাকায়ও নড়বড়ে।  মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসও ভোটারদের কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রী রাজিউদ্দীন রাজুও ঝুঁকির মধ্যে আছেন। নরসিংদী-৫ (রায়পুরা) আসনে নরসিংদী পৌরসভার প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের অনুগামীরা আগামী নির্বাচনে রাজিউদ্দীন রাজুর প্রকাশ্য বিরোধিতায় নামবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের পরবর্তী নির্বাচনী ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন, শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরীর অবস্থাও নড়বড়ে বলে বিভিন্ন সংবাদ ও গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ জরিপে উঠে এসেছে।  পটুয়াখালী-৩ আসনের সাংসদ গোলাম মাওলা রনির বিরুদ্ধে সাংবাদিক মারধরের পাশাপাশি গলাচিপা-দশমিনার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টেন্ডারবাজি, টিআর-কাবিখাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। ভোলা-৩ আসনের এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের বিরুদ্ধে যুবলীগ নেতা ইব্রাহিমকে খুনসহ বিভিন্ন দুর্নীতি-অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তার তেমন যোগাযোগ নেই। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তৎপর না থাকায় জনগণও তার ওপর অসন্তুষ্ট বলে জানিয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। কক্সবাজারের একটি আসন থেকে নির্বাচিত এমপি আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর, শিক্ষককে প্রহারসহ বিভিন্ন অভিযোগে তার ইমেজ স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি দলের কাছেও ভালো নয়। গোয়েন্দা রিপোর্টেও বদির বিষয়ে অভিযোগ এসেছে। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি সারাহ বেগম কবরী এবং স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের মধ্যে বিরোধের কারণে একাধিকবার আলোচনায় এসেছেন সাবেক এই অভিনেত্রী। সারাদেশে স্বাধীনতার পক্ষের জনগন এদেরকে প্রতিহত করতে তৈরি। কেননা, এরা রাজনীতিকে জনসেবা ব্যবসা মনে করে। ১০ কোটি টাকা করচ করে নির্বাচিত হলে ১০০ কোটি টাকা কামানোর চেষ্টায় মশগুল থাকে। না জনতা, না দেশ, না স্বাধীনতা। তাদের কাছে মূল হলো টাকা আর টাকা।
এই পরিস্থিতিতে আবার জয়কে নামানো হয়েছে রাজনৈতিক প্রচারণায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ হয়তো ভুলেই গেছে, এই দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে। সেই স্বাধীনতা আজ ভুলুন্ঠিত। ভুলুণ্ঠিত স্বাধীনতাকে ফিরিয়ে আনতে তৈরি তারা। এবার রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের নতুন প্রজন্মের রায়ে। তারা দুর্নীতিবাজ-সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ আর মিথ্যুকদেরকে আর ক্ষমতায় আনবে না। সে আওয়ামী লীগ-ই হোক আর বিএনপি বা জামায়াত। তারা রাজনৈতিক সচেতনতার রাস্তায় এগিয়ে যেতে যেতে তৈরি। অতএব, বোকা বানানোর চেষ্টা  করে কোন লাভ নেই। যাকে, যে দলকে জনগন নিজেদের আপন মনে করবে সেই দলকেই ক্ষমতায় আনতে তৈরি হবে তারা। কোন উত্তরসূরী-পূর্বসূরীর কথায় এবার একটা ভোটও এদিক- সেদিক হবে না…
[মোমিন মেহেদী : কলামিস্ট ও আহবায়ক, নতুনধারা বাংলাদেশ।।]

অতিথি লেখক