তামাকের রাস্তায় আমাদের নারী

তামাকের রাস্তায় আমাদের নারী

মোমিন মেহেদীঃ

৩১ মে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস,তবে দিবসটি পালিত হবে ১১ জুন। তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিশ্বের ১৭৬টি  দেশে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালিত হবে। অন্যসব দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপিত হবে। তবে তামাকমুক্ত দিবস শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় বাংলাদেশে ১১ জুন এই দিবস উদযাপন করা হবে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘তামাকের সব বিজ্ঞাপন ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ।
তামাক হলো মাদকের প্রথম স্তর। আমরা দেখি যে, সিগারেট অথবা বিড়ি দিয়ে মাদকদ্রব্যের সাথে পরিচিতি ঘটে মানুষের। এরপর ধারাবাহিকভাবে গাঁজা, ফেন্সিডিল, ইয়াবা, মদ, হেরোইন, প্যাথোডিন, মরফিনসহ বিভিন্ন স্তরের মাদকে আশক্ত হয় আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এক্ষেত্রে সবার আগে সবচেয়ে যে বিষয়টি ক্ষতি বেশি করে, সে বিষয়টি হলো- পরিবারের বাবা, বড় ভাই, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক, ছাত্র রাজনীতির নেতা বা বখাটে অগ্রজ, পাড়া বা মহল্লায় এলাকার মুরুব্বীদের তামাকদ্রব্য ব্যবহার। তারা যখন ৮ থেকে ১৮ বা ২০ বছর বয়সী একজন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধির সামনে নির্বিঘেœ ধুমপান করেন, তখন নতুন প্রজন্মের ঐ প্রতিনিধি ভাবে যে, আমার বাবা, বড় ভাই, শিক্ষক বা মুরুব্বীরা যেহেতু ধুমপান করছে, আমিও একটু দেখিতো কেমন এর স্বাদ। খেলে কি হয়? আর সেই যে স্বাদ নেয়ার জন্য শুরু হয়; আর থামে না মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। এক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন প্রচারও একটা বড় ক্ষতির দিক বলে মনে করি আমি। পাশাপাশি সরকারের উদাসিনতাতো রয়েছেই। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, একটা বিল পাশ করে। তারপর সেই পাশ করা বিল সংশ্লিষ্ট আইনগুলো পরবর্তী সরকার এসে বাতিল করে। বিশেষ করে বললে বলা যায় ‘প্রকাশ্যে ধুমপান করলে জরিমানা’ আদায়ের কথাই। এই আইন চালু হওয়ার পর দেশে প্রকাশ্যে ধুমপান কমেছিলো। কিন্তু পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার এসে সেই আইনকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। যে কারনে বেড়ে যায় ধুমপান, মদপানসহ বিভিন্ন নেশাদ্রব্য প্রকাশে সেবনের রীতি। এভাবে বাংলাদেশকে কোন সরকার খেলার পুতুল হিসেবে ব্যবহার করবে বলে দেশ স্বাধীন করেনি বাংলার দামাল ছেলেরা। তারা চেয়েছিলেন নতুন করে দেশ গড়তে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সেই দেশ গড়ার প্রতি লক্ষ্য না দিয়ে নিজেদের আখেড় গোছানোর জন্য নিবেদিত থাকেন সবসময়। এমতবস্থায় আমাদেরকে, সাধারন মানুষদেরকে কষ্ট করে হলেও কাজ করতে হবে। কেননা, সবার আগে দেশ । দেশের জন্য নিবেদিত থাকলে তামাকমুক্তই শুধু নয়; দেশ হবে মাদকমুক্ত, ধর্ষণমুক্ত, খুনমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত। কেননা, একটি জরিপে দেখা গেছে যে, মাদক-ই হলো সকল সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের উৎস।

বলা হয়ে থাকে যেখানে উন্নত বিশ্বে তামাক সেবনকারীদের সংখ্যা দিন দিন কমছে, সেখানে বাংলাদেশে এই সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে।  কারন হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি ও সমাজনীতি নিয়ে এগিয়ে চলার সূত্র ধরে আমার কাছে যে বিষয়টি বারবার ধরা পড়েছে, সে বিষয়টি হলো- তামাকজাতদ্রব্য থেকে শুরু করে প্রায় সকল মাদকদ্রব্যই বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে সুলভে পাওয়া যায় আমাদের এই বাংলাদেশে। সুলভে তামাকদ্রব্য-মাদকদ্রব্য এজন্য পাওয়া যায় যে, আমাদের রাজস্বখাতে তামাক ও মাদকদ্রব্যের ভ্যাট সবচেয়ে কম।  যে কারনে নতুন করে যখন গবেষণা করা হয়, তখন গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সারভে (গ্যাটস) ২০০৯-এ প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠী শতকরা ৪৩.৩ ভাগ লোক তামাক ব্যবহার করে। শতকরা ২৩ ভাগ লোক ধোঁয়ামুক্ত এবং ২৭.৩ ভাগ লোক ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো শতকরা ৬৩ ভাগ লোক কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার।’ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালের এক গবেষণা মতে, তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫৭ হাজার মৃত্যুবরণ করে এবং ৩ লাখ ৮২ হাজার লোক পঙ্গুত্ববরণ করে। ‘জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে বর্তমান সরকার ২০০৫ সালে প্রণীত আইনকে আরো শক্তিশালী করেছে। ২৯ এপ্রিল জাতীয় সংসদে ধূমপান এবং তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ২০১৩ আইন সংশোধন করা হয়। বর্তমান সরকার পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য জরিমানা ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করেছে। এই যে আইন করা হয়েছে, সেই আইন মানার মত লোক না সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে পাওয়া যাবে, না প্রশাসনে। যদিও তামাক নিয়ন্ত্রণে জেলা-উপজেলায় টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে সিভিল সার্জন এবং জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এমন একটি সময়ে আমরা এসে উপনীত হয়েছি, যেই সময়ে আমাদের জীবনের নিরাপত্তাই সরকারের কাাছে নেই। সেখানে মাদকমুক্ত করতে হলে দেশে যে শক্তিশালী প্রশাসনিক কঠোরতা তৈরি করতে হবে, তা অন্তত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শাসনামলে সম্ভব নয় বলেই আমার বিশ্বাস। অবশ্য এক্ষেত্রে আমরা সাধারন জনতা যদি সচেতন হই, গড়ে তুলি সচেতনতার রাস্তা; সেক্ষেত্রে একটা রেজাল্ট পাওয়া যেতে পারে।  যতদূর মনে পড়ে এর আগে এক বছরের তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল জেন্ডার এবং তামাক। তখন নারীদের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তামাক-বাজার থেকে এবং তামাক পান থেকে নারীদের বিরত রাখা ও সুরক্ষার জন্য জোর তাগিদ জানানো হয়। তামাকের ব্যবসায়ীরা অবিরাম সন্ধান করছেন নতুন তামাক-ব্যবহারকারীদের, যাঁরা তামাক পান ও সেবন ছেড়ে দিচ্ছেন তাঁদের স্থান পূরণের জন্যই এই আগ্রাসী অনুসন্ধান। এসব তামাকসেবী অকালে মৃত্যুবরণ করতে পারেন হার্ট অ্যাটাক, ক্যানসার, স্ট্রোক, এমফিসিমা ও তামাক সেবন থেকে উদ্ভূত অনেক রোগে; অথচ ব্যবসায়ীদের বাজার সম্প্রসারণের আগ্রহ মোটেও কমেনি। নানা প্রলোভনের জাল বিস্তার করে তাঁরা বাজারকে আরও বাড়াতে চাইছেন। তামাকশিল্পের মালিকেরা খুঁজছেন নতুন সুযোগ, তাঁদের বৃহত্তর লক্ষ্য হলো নারী। কারণ, পুরুষের চেয়ে অনেক কম নারী ধূমপান করেন বা তামাক চেবান। যেখানে তামাক সেবন করে ৪০ শতাংশ পুরুষ, সেখানে নয়শতাংশ নারী তামাক সেবন করে। বিশ্বের ১০০ কোটি তামাকসেবীর মধ্যে মাত্র ২০০ মিলিয়ন নারী। তাই তামাক-বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকদের নতুন লক্ষ্য নারী-ধূমপায়ী তৈরি করা। আরেকটি কথা, কোনো কোনো দেশে যখন পুরুষ-ধূমপায়ীর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে, সেখানে তখন বাড়ছে নারী-তামাকসেবীর সংখ্যা। বিশ্বজুড়ে তামাক সেবনের যে চিত্র, এর মধ্যে নারী-তামাকসেবীদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠছে। ১৫১টি দেশে তরুণদের মধ্যে তামাক সেবনের যে সমীক্ষণ করা হয়েছে, এর মধ্যে অর্ধেকই তরুণী। কোনো কোনো দেশে তরুণদের চেয়ে তরুণীরা বেশি ধূমপান করে। যেমন টিনএজাররা ধূমপান শুরু করে, পূর্ণবয়স্ক হলে চেইন স্মোকারে পরিণত হয়। প্রতিবছর তামাক ব্যবহারের জন্য পৃথিবীতে মৃত্যুবরণ করে ৫০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে নারী ১৫ লাখ। জরুরি ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালে তামাক সেবনের কারণে মৃত্যুবরণ করবে ৮০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ২৫ লাখ নারী। এ কারণে নারীমৃত্যুর আনুমানিক তিন-চতুর্থাংশ ঘটবে নিম্ন-আয় ও মধ্য-আয়ের দেশগুলোতে। এসব অকালমৃত্যুর প্রতিটিই প্রতিরোধযোগ্য। কোনো কোনো দেশে, অন্যদের ধূমপান, বিশেষ করে পুরুষ-ধূমপায়ীর সিগারেটের ধোঁয়া সেবন করে বেশির ভাগ নারী ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। যেমন, চীন দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, প্রায় সবাই পুরুষ-ধূমপায়ী, নারীরা এদের সিগারেটের ধোঁয়া সেবন করে পরোক্ষভাবে, অথচ চীনে তিন শতাংশের কম নারী ধূমপান করে। এই সেকেন্ড-হ্যান্ড স্মোক বা অন্যের ধূমপানের জন্য ধোঁয়া সেবন করে পৃথিবীজুড়ে ছয় লাখ লোকের মৃত্যু ঘটছে, এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ নারী।
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০১০, তামাক বাজারজাতকরণ ও তামাক সেবন নারীদের যে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে সেদিকে দৃষ্টিপাত করেছে। একই সঙ্গে যেসব নারীর সঙ্গে তাঁরা থাকেন বা বসবাস করেন, সেসব পুরুষকে নারীদের সামনে ধূমপান থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত বিশ্ব জনগোষ্ঠীর মাত্র নয় শতাংশ তামাকের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধের আওতায় রয়েছে। নারীরা এখন বড় ঝুঁকিতে। এখন সময় কাজ করার। নারীদের লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপনের জাল বিস্তারে রত তামাকের ব্যবসায়ীরা। নারীরা ক্রমেই অর্থনৈতিকভাবে সবল ও মুক্ত-স্বাধীন হচ্ছে, এতে তামাক সেবনে অর্থ ব্যয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, এও একটি কারণ।
তামাক কোম্পানিগুলোর মূল লক্ষ্য হলো নিম্ন-আয় ও মধ্য-আয়ের দেশগুলো। সেখানে নতুন নারী-ধূমপায়ী বেশি। অনেক দেশে ‘সেকেন্ড-হ্যান্ড স্মোক’ থেকে জনগণের সুরক্ষার বিধিবিধান নেই। অনেক নারী এই ক্ষতিকর দিকের কথা জানেও না। নারীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রভাবও পুরুষের চেয়ে একটু ভিন্ন। এমনও দেখা গেছে, তামাকের বিজ্ঞাপনে ধূমপান করাকে নারী মুক্তির উপায় হিসেবে উপস্থাপন করা অথবা ক্ষীণাঙ্গী থাকার উপায় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের বিজ্ঞাপন বা প্রচার অনেক সময় প্রলুব্ধ করে নারীকে। ধূমপায়ী বা তামাকসেবী নারীদের মধ্যে বন্ধ্যত্ব এবং দেরিতে সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশঙ্কা বেশি। গর্ভধারণকালে ধূমপান করলে অকালপ্রসব, মৃতশিশু প্রসবের ঘটনা ঘটে বেশি। কমে যায় স্তনের দুধক্ষরণও। ধূমপানে নারীদের সার্ভিক্সের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে, বাড়ে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিও। অনেক তামাক-নিয়ন্ত্রণ কৌশলের মধ্যে যেসব নারী তামাকপাতা, গুল, জর্দা চেবান, তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ধূমপায়ীর মতো তাঁরাও সমভাবে ঝুঁকির মধ্যে থাকেন।
অতএব, বাংলাদেশের আগামীকে কালো থেকে আলোকিত করতে তৈরি হতে হবে সবাইকে। তৈরি হতে হবে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে। যারা শাহবাগ থেকে সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, তারা অবশ্যই চাইলেই পারবে বাংলাদেশ থেকে তামাক এবং মাদকদ্রব্যের অবাধ ব্যবহার বন্ধের জন্য নিবেদিত থেকে সচেতনতা তৈরি করতে। এই কাজটি যদি নতুন প্রজন্ম প্রত্যয়ের রাস্তায় এগিয়ে এসে করে, তাহলে এখন যেমন যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজ চলছে, ঠিক তেমন তামাক ও মাদকমুক্ত দেশ গড়ার কাজ চলবে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত। শ্লোগান উঠবে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া/তামাক-মাদক দে তুলিয়া/ দেশ হবে নেশামুক্ত/ সমাজ হবে পেশাযুক্ত/ সবাই হবে কাজের লোক/ দেশটা নেশা মুক্ত হোক…

মোমিন মেহেদী : কলামিস্ট ও আহবায়ক, নতুনধারা বাংলাদেশ(এনডিবি)

Website: www.mominmahadi.com

অতিথি লেখক