ফকির লালন শাহকে নিয়ে যত কথা

ফকির লালন শাহকে নিয়ে যত কথা

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামানিকঃ বিদগ্ধ ও পণ্ডিতজনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে চাই আগেই। তাদের মতো লালন বিষয়ে পড়াশোনা, তত্ত্বতালাশ এবং সাঁইজীর জন্ম-মৃত্যু, জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে গবেষণা আমার নেই। সাঁইজীর ধামের প্রতিবেশী হিসেবে ছোটবেলা থেকে গান শুনেছি একান্ত মনোযোগী শ্রোতা হয়ে। সাঁইজীর গানের মুদ্রিত পাঠ যেখানে যত রকম পাওয়া যেতো সংগ্রহ করেছি ক্রমে ক্রমে। নানা রকম পাঠভেদ মেনে নিয়ে পড়েছি অসংখ্যবার, এখনও পড়ি। সাঁইজি ভক্ত খাঁটি বাউলদের কাছ থেকে শুনেছি অনেক গল্প। সেসব মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমি আমার মতো করে সাঁইজিকে নিয়ে লিখছি। কুষ্টিয়া শহরের অদূরে ছেঁউড়িয়া একটি ছায়াঘেরা নিবিড় গ্রাম। একপাশে গড়াই অন্য পাশে কালিগঙ্গা দু’টি বহমান নদী। আজ থেকে প্রায় দুইশত পঁচিশ বছর আগের একদিন ভোরবেলা ষোল-সতের বছর বয়সের অচেতন লালন ভাসতে ভাসতে কালিগঙ্গা নদীর তীরে এসে ভিড়ল। ছেঁউড়িয়া গ্রামের মওলানা মলম কারিকর নামাজি লোক। সেদিন ভোরবেলা মওলানা মলম ফজরের নামাজ পরে কালিগঙ্গা নদীর দিকে হাওয়া খেতে আসলেন, হঠাৎই দেখতে পেলেন এক অচেনা সংজ্ঞাহীন যুবক অর্ধজলমগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে, ছেলেটির মুখে ও শরীরে বসন্ত রোগের দাগ বিদ্যমান। তিনি কাছে গিয়ে দেখলেন ছেলেটি বেঁচে আছে, খুব ধীরলয়ে চলছে শ্বাস-প্রশ্বাস। নিঃসন্তান হাফেজ মলমের বুকের ভেতর হু হু করে উঠল, এ কোনো অচেনা যুবক নয়; খোদা যেন তাঁর সন্তানকেই ভাসিয়ে এনেছেন তাঁর কাছে। মলম তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফিরলেন এবং তাঁর অপর তিন ভাইকে সাথে নিয়ে আসলেন। এবার চার ভাইয়ে ধরাধরি করে অচেনা যুবককে নিজের বাড়িতে আনলেন। মলম ও তার স্ত্রী মতিজান দিনরাত সেবা-যত্ন করতে লাগলেন। দিনে দিনে অচেনা যুবকটির মুখে জীবনের আলো ফিরে এলো। মতিজান জিজ্ঞাসা করল বাবা তোমার নাম কী? ………ফকির লালন।
আমৃত্যু ফকির লালন ছেঁউড়িয়াতেই ছিলেন, মৃত্যুর পর ছেঁউড়িয়ার আঁখড়াবাড়িতেই তার সমাধি নির্মিত হয়। ছেঁউড়িয়া ভিত্তিক লালনের জীবন বৃত্তান্ত বিস্তারিতভাবে খুঁজে পাওয়া যায় ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহের সম্মাদিত লালন সংগীত নামক গ্রন্থে। লালন কোথায় ছিল, কিভাবে কালিগঙ্গা দিয়ে ভেসে আসলো এসব বিষয়ে যে তথ্য পাওয়া যায় তা সর্বজনগ্রাহ্য নয়। কথিত আছে গঙ্গা স্নান সেরে ফেরার পথে লালন বসন্ত রোগে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। রোগের প্রকোপে অচেতন হয়ে পড়লে সঙ্গীসাথীরা তাঁকে মৃত মনে করে রোগ সংক্রমণের ভয়ে তাড়াতাড়ি মুখাগ্নি করে নদীতে ফেলে দেয়। লালনের জন্ম আসলে কোথায় তা আজো নিশ্চিত করে বলা যায়না। কোন কোন লালন গবেষক মনে করেন, লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। এই মতের সাথে অনেকেউ দ্বিমত পোষণ করেন এই বলে যে, ছেঁউড়িয়া থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের ভাড়ারা গ্রামের ষোল-সতের বছরের একটি যুবক নিখোঁজ হলো অথচ তার দীর্ঘ জীবদ্দশায় তাঁকে তার কোন আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিচিতন জন কেউ চিহ্নিত করতে পারলোনা-তা এক বিস্ময়কর ব্যপার। ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত মাসিক মোহম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ী গ্রামের মুসলিম পরিবারে বলে উল্লে¬খ করা হয়। অন্যদিকে পানজুশাহের ছেলে খোন্দকার রফিউদ্দিন তাঁর ভাবসংগীত নামক গ্রন্থে ফকির লালনের জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন ফকির লালন শাহের জন্মভূমি যশোর জেলার হরিণাকুন্ডু থানার অধীন হরিশপুর গ্রামেই ছিল, ইহাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। লালনের জন্ম স্থান সম্পর্কে লালন গবেষক ড. আনোয়ারুল করিমের ধারণাটি ছিলো অনবদ্য,
“আমি দীর্ঘ ১০ বছর লালন ফকিরের জীবনী সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান করে বেড়িয়েছি।
কিন্তু তাঁর জাতিত্ব পরিচয় রহস্যময়। আসলে লালন নিজও তাঁর জন্ম পরিচয় প্রদান করতে উৎসাহবোধ করেননি, তা তাঁর গানেই স্পষ্টমান-
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন কয় জাতের কিরূপ
দেখলাম না এই নজরে।।
সত্যিই তাই, জাতপাতের উর্দ্ধে উঠে লালন নিজেকে শুধুই মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে গেছেন।
লালন হিন্দু কি মুসলমান এ নিয়েও বিস্তর মতামত পাওয়া যায়। কারো মতে লালন কায়স্থ পরিবারের সন্তান যার পিতা মাধব এবং মাতা পদ্মাবতী; পরে লালন ধর্মান্তরিত হন। গবেষকদের মতে বেশির ভাগই মনে করেন লালন মুসলিম তন্তুবায়ী পরিবারের সন্তান। লালন ফকির নিজের জাত পরিচয় দিয়ে গিয়ে বলেছেন-
সব লোকে বলে লালন ফকির কোন জাতের ছেলে।
কারে বা কী বলি আমি
দিশে না মেলে।।
রোগ মুক্তির কিছুদিন পর লালন ফকির বিদায় চাইলেন, বললেন আমি সংসার ত্যাগী মানুষ; এই ভবসংসারে আমার ঠাঁই নাই। কথিত আছে লালন অলৌকিকভাবে হেঁটে কালিগঙ্গা পার হয়ে যায়। পরে অবশ্য মলম ডিঙি নৌকা নিয়ে পার হয়ে প্রায় দৌড়ে গিয়ে লালনকে ধরে ফেলে এবং ছেঁউড়িয়া ফিরে যাবার জন্য ব্যথিত হৃদয়ে অনুরোধ করে। লালন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে যে, যেতে পারি তবে আমার জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। নিঃসন্তান মলম তাঁর প্রিয় সন্তানের কথা রাখলেন। কালিগঙ্গা নদীর তীরে শ্যামল বৃক্ষমন্ডিত মলমের বাগানে তৈরী হলো চৌচালা ঘর আর আঁখড়াবাড়ি। চৌচালা ঘরটি লালন সাধনকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতেন। কালের নিয়মে ছনের ঘরটি বিলীন হয়ে গেলেও মহান সাধক লালনের পরশমাখা সাধনকক্ষের কপাটজোড়া এবং জলচৌকি এখনো লালন একাডেমির যাদুঘরে রাখা আছে। এই আঁখড়াবাড়িটিই ক্রমে সাধন ভজনের পূন্যধামে পরিণত হয়। ফজরের নামাজের পর মওলানা মলম কোরআন তেলাওয়াত করতেন, ফকির লালন মনোযোগ দিয়ে তেলাওয়াত শুনতেন. মানে জিজ্ঞাসা করতেন। লালন কোরআনের কিছু কিছু আয়াতের আধ্যাত্বিক ব্যাখ্যা করতেন, ব্যাখ্যা শুনে মওলানা মলম অভিভূত হয়ে যেতেন। লালনের প্রতি অপরিসীম ভক্তি ও অনুপ্রাণিত হয়ে এক সময় মলম ও মতিজান লালনের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে । মলম কারিকর থেকে হয়ে যান মলম শাহ অন্যদিকে মতিজান হয়ে যান মতিজান ফকিরানী। ফকির মলম শাহ ছিলেন সর্বাপেক্ষা বয়োৈেজষ্ঠ্য শিষ্য। মলমের অপর দুই ভাই কলম ও তিলম সস্ত্রীক পর্যায়ক্রমে লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। লালনের মুখে বসন্তের দাগ ছিলো, তাঁর হাত দুটো এতো লম্বা ছিলো যে দাঁড়ালে আঙ্গুলগুলো হাঁটুর নিচে পড়তো। উঁচু নাক, উন্নত কপাল আর গৌরবর্ণের লালনের ছিলো গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন চোখ। কাঁধ বরাবর চুল,লম্বা দাড়ী, হাতে ছড়ি, পায়ে খড়ম, গায়ে খেলকা, পাগড়ী, আঁচলা, তহবন-সব মিলিয়ে লালন যেন বকে সিদ্ধপুরুষ, পরিপূর্ণ সাধক। লালন মুখে মুখেই গানের পদ রচনা করতেন। তাঁর মনে নতুন গান উদয় হলে তিনি শিষ্যদের ডেকে বলতেন, ‘পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে’। লালন গেয়ে শোনাতেন, ফকির মানিক ও মনিরুদ্দিন শাহ সেই বাঁধা গান লিখে নিতেন। লালনের জীবদ্দশাতেই তাঁর গান বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। ফকির মানিক শাহ সেই সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ গায়ক ছিলেন। লালনের শিষ্যদের ধারণা তার গানের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশী। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এতো বিপুল সংখ্যক গান পাওয়া যায় না। শোনা যায় লালনের কোন কোন শিষ্যের মৃত্যুর পর গানের খাতা তাদের কবরে পুঁতে দেয়া হয়। এছাড়াও অনেক ভক্ত গানের খাতা নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেননি। ছেঁউড়িয়ায় কয়েক বছর থাকার পর লাল তাঁর শিষ্যদের ডেকে বললেন, আমি কয়েক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি তোমরা আমার সাধনকক্ষটার দেখাশুনা করো। সপ্তাহ তিনেক পর তিনি একটি অল্পবয়স্কা সুশ্রী যুবতিকে নিয়ে ফিরলেন । মতিজান ফকিরানী জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েটা কে বাবা? তোমাদের গুরুমা। একথা শোনার পর আঁখড়াবাড়ির সকলেই গুরুমাকে ভক্তি করলেন। বিশখা নামের এই মেয়েটি সারাজীবন লালনের সাথে ছিলেন। লালনের মৃত্যুর তিনমাস পর সেও মারা যান। বিশখা ফকিরানী প্রায় একশো বছর ধরে ছেঁউড়িয়ায় ছিলেন কিন্তু তাঁর প্রকৃত নাম পরিচয় জানা যায়নি। এমনকি মৃত্যুর পরও তার কোন আত্মীয় বা পরিচিতজনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অচিন মানুষ ফকির লালনের মতোই বিশখা ফকিরানী আজো এক অচিন নারী। ফকির লালন একদিন তাঁর সাধনঘরে একা একা বসেছিলেন। এমন সময় খোকসা থানার কমলাপুর গ্রামের দুইজন ভক্ত এসে জানালেন যে তাদের গ্রামে কলেরা লেগেছে, সেখানকার ভক্ত ফকির রহিম শাহ তাঁর নাবালক পুত্র এবং স্ত্রীকে রেখে কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সব শুনে লালন খুব মর্মাহত হলেন। ফকির রহিম শাহের নাবালক পুত্র শীতলকে নিজের কাছে আনলেন। বিশখা ও লালন তাকে পুত্র স্নেহে লালন পালন করতে লাগলেন। অন্যদিকে বেশ কয়েক বছর পর ফকির শুকুর শাহ তাঁর মাতৃহারা কন্যাকে লালনের কাছে নিয়ে আসেন, লালন সস্নেহে তাকে কোলে তুলে নিলেন এবং বিখশাকে বললেন- আজ থেকে এই শিশুটিও তোমার কন্যা। পরীর মতো সুন্দর এই মেয়েটিকে লালন পরী না বলে প্যারিনেছা বলে ডাকতেন। ভোলাই শাহ লালনের একান্ত শিষ্যদের অন্যতম, বাল্যকাল থেকেই সে আর শীতল একই ঘরে থাকতেন। ভোলাই শাহ বড় হয়ে কোন এক দোল পূর্ণিমার রাতে প্যারীনেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। ফকির লালনকে নিয়ে বেশ কিছু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। একবার লালন তাঁর শিষ্যদের নিয়ে গঙ্গানদী পার হয়ে নবদ্বীপ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূর ধামে পৌঁছালেন। মন্দিরের লোকজন আগন্তকদের বেশভূষা দেখে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো, লালন শিষ্য শীতল শাহ বললো আমরা কুষ্টিয়া থেকে এসেছি, সকলেই ফকির মতবাদের সাধক। তখন মহাপ্রভূর কাছে গিয়ে বলা হলো যে কুষ্টিয়া থেকে কিছু সংখ্যক ফকির এসেছে যাদের বেশির ভাগ মুসলমান। মহাপ্রভূ সবশুনে তাদের বসার ব্যবস্থা করতে বললেন। আঙিনার একপাশে বড় নিমগাছের তলায় তাদের জায়গা করে দেয়া হলো। সারারাতের অনুষ্ঠান শেষে সাধুগুরু এবং বোষ্টমিদের সেবা দেয়ার পর যুবকরা পিতলের থালায় করে সোয়াসের চুন নিয়ে এলো এবং সবাইকে বলা হলো পাতুন, মহাপ্রভূর প্রসাদ গ্রহণ করুন। চুনে মুখ পুড়ে যাবে এই ভয়ে শিষ্যরা কেউ হাত পাতলো না। বরং একযোগে ক্ষমা চাইলো। যুবকেরা বলল- আপনারা কেমন সাধু! চুনে মুখ পুড়ে যাবার ভয়ে কেউ হাত পাতলেন না। প্রকৃত সাধুদের তো মুখ পোড়ার কথা নয়! লালন এক কোণায় বসেছিলেন, যুবকদের এই কথা শুনে বলল-
তোমরা কি চাও?
-তোমরা কেমন সাধু হয়েছো তা দেখতে চাই।
লালন যুবকদের কলার পাতা এবং একটি চাড়ি আনতে বলল। অতঃপর তিনি খানিক চুন কলার পাতা রেখে বাকি চুন চাড়ি ভর্তি পানিতে গুলিয়ে দিলেন। এবার তিনি নিজেই কলারপাতার চুনগুলো খেয়ে ফেললেন এবং শিষ্যদের চাড়ি থেকে গ্লাসে করে চুনগোলানো শরবত খাওয়ালেন। তাঁরা সকলেই শরবত পানের তৃপ্তি লাভ করলো। এই শরবত পান চুন সেবা নামে পরিচিত। লালন ঘোড়ায় চড়তেন, মাঝে মাঝে গভীর রাতে চাঁদের আলোতে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন, কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন তা তাঁর শিষ্যরা কেউ বলতে পারতোনা। লালন একাডেমির খাদেমকে লালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে জানায় আমার দাদাগুরু ভোলাই শাহের কাছে শুনেছি লালন রাতের বেলায় দুধ দিয়ে খই ভিন্ন অন্য কোন খাদ্য খেতেন না। প্রায় সারারাত জেকের আসকার ও এবাদত করতেন, একটু পর পর পান খেতেন। তখন আঁখড়াবাড়িতে পানের বরজ এবং অনেক ঝোপজংগল ছিলো। ভক্তরা ভারতের গয়া থেকে ফকির লালনের জন্য চুন নিয়ে আসতে, সেই চুনে তিনি পান খেতেন। এই প্রসঙ্গে তিনি আরো জানান যে, নবদ্বীপ থেকে এখনো কিছু কিছু লালনভক্ত আঁখড়ায় আসে, তাদের কাছে সে শুনেছে যে নবদ্বীপে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ধামে লালন ও তাঁর শিষ্যদের যে চুনসেবা দেয়া হয়েছিলো সেই চুনসেবায় লালনের যে আসন পাতা ছিলো তা এখনো সংরক্ষিত আছে। ওই খাদেমের ধারণা, হয়তো দোল পূর্ণিমার তিথিতে জন্ম গ্রহন করেছিলেন বলেই লালন তাঁর জীবদ্দশায় ফাগুন মাসের দোল পূর্ণিমার রাতে খোলা মাঠে শিষ্যদের নিয়ে সারারাত ধরে গান বাজনা করতেন। সেই ধারাবাহিকতায় এখনো লালন একাডেমি প্রতি বছর ফাগুন মাসের দোল পূর্ণিমার রাতে তিনদিন ব্যাপী লালন স্মরণোৎসবের আয়োজন করে থাকে। লালন চত্বর ছাড়াও আঁখড়ার অভ্যন্তরভাগসহ সর্বত্র দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা হাজার হাজার বাউলরা ছোট ছোট দলে সারারাত ধরে গান করে। এছাড়াও প্রতি বছর ১লা কার্তিকে লালনের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে অনুরুপ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দেশ বিদেশের হাজার হাজার বাউল যোগ দেয় সেই উৎসবে, দোল পূর্ণিমার জোসনায় বাউলরা আকাশের দিকে হাত তুলে গান ধরে………..
এলাহি আল আমিনগো আল্লাহ বাদশা আলমপানা তুমি।
ডুবাইয়ে ভাসাইতে পারো, ভাসাইয়ে কিনার দাও কারোও
রাখো মারো হাত তোমার, তাইতো তোমায় ডাকি আমি। ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে লালনের যথেষ্ঠ সখ্যতা ও ভাববিনিময় ছিলো। জমিদারীর তাগিদেই রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে থাকতেন, পদ্মার পাড়ের নির্জনতায় বসে কাব্য রচনা করতেন। ফকির লালনের সাথে যখন তাঁর পরিচয় ঘটে তখন তিনি বয়সে তরুণ। তিনি একবার লালনের আঁখড়ায় এসেছিলেন, গভীর অথচ সহজ ভাষায় বাধাঁ লালনের গান তাঁকে মুগ্ধ করেছিলো, সেই থেকেই তাদের মধ্যে ভাবের লেনদেন। রবীন্দ্রনাথ কোথাও যেতে হলে পালকি ব্যবহার করতেন, লালন ফকির ঘোড়ায় চড়তেন। লালন ফকির ঘোড়ায় চড়েই কুঠিবাড়িতে দু’একবার এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই তাঁর বোট নিয়ে পদ্মায় ঘুরে বেড়াতেন। রবীন্দ্রনাথের সেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই বোটে বসা ভ্রমণরত ফকির লালনের একটি স্কেচ এঁকে ফেলেন যার একটি কপি এখনো লালন একাডেমির মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। লালন ফকির ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে যে গভীর ভাববিনিময় ছিল তার একটি তথ্যবহুল বিবরণ পাওয়া যায় ড. আবুল আহসান চৌধুরী রচিত ‘লালন সাঁইয়ের সন্ধানে’ নামক গবেষণামূলক গ্রন্থে। লালনের গান রবীন্দ্রনাথকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিলো তা কাঁর কবিতা পাঠ করলেই বোঝা যায়। শুধু কবিতায় নয়, রবীন্দ্রনাথের বেশভূষাতেও এসেছিলো অনবদ্য এক বাউলপনা। আলখেল্লা পরা বাবরী চুলের শশ্র“মন্ডিত রবীন্দ্রনাথ যেন বাউল বেশে লিখে চলেছেন-
‘একলা প্রভাতের রৌদ্রে সেই পদ্মানদীর ধারে, যে নদীর নেই কোন দ্বিধা পাকা দেউলের পুরাকত ভিত ভেঙে ফেলতে’। একদা শান্তি নিকেতনে ফিরে যাবার পর প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথ কালীমোহন ঘোষকে বলেছিলেন-
‘ভুমিতো দেখেছো শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যদের সহিত ঘন্টার পর ঘন্টার আমার কিরূপ আলাপ জমত। পোষাক পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝবার জো নাই তারা কত মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় কত সহজভাবে তারা বলতে পারতো।’ এই থেকে বোঝায় তিনি তাঁর উপলদ্ধি কিভাবে শ্রদ্ধা করতেন, লালন ও তাঁর বাউল সমাজকে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও অনেক জায়গায় বলেছেন- তাঁর অনেক গানেই লালনের ভাবধারা বিদ্যমান আছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম লালনের গান সংকলন করেন। গভীর জ্ঞানের  অধিকারী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীরভাবেই উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন ফকির লালন এবং তাঁর গানকে। তাইতো অঁজো পাড়াগাঁর সমাজ বঞ্চিত ফকির লালন এবং তাঁর গরীব শিষ্যরা উঠে এসেছে তাঁর গানে, কবিতায়-উপন্যাসে। লালন দর্শনের একটি অন্যতম দিক হলো গুরুবাদ। গুরুর প্রতি ভক্তি নিষ্ঠাই হলো তাদের শ্রেষ্ঠ সাধনা। ধ্যান ছাড়া যেমন গুরকে ধারণ করা যায় না তেমন গুরুর প্রতি অসামান্য ভক্তি ছাড়া অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ হয় না। মানুষের প্রতি ভালবাসা, জীবে দয়া, সত্য কথা, সৎ কর্ম, সৎ উদ্দেশ্য- এই হলো গুরুবাদী মানব ধর্মের মূল কথা। মূলত ভক্তিই মুক্তি-
ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার।
সর্ব সাধন সিদ্ধ  হয় তার।।
যারা হাওয়ার সাধনা করে তারাই মূলত বাউল, তাদের মতে সাধনার চারটি স্তর আছে;- স্থুল, প্রবর্ত, সাধক ও সিদ্ধ। প্রথম পর্যায়ের শিক্ষা হলো স্থূল, দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবর্ত, তৃতীয় পর্যায়ে সাধক এবং চতুর্থ বা চূড়ান্ত পর্যায়ের শিক্ষা হলো সিদ্ধ। লালনের গানেও দেখা যায় সেই ভাবদর্শন ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে।
সেকি সামান্য চোরা
ধরবি কোণা কানচীতে।।
লালন তাঁর অসংখ্য গানের মধ্য দিয়ে পরিশুদ্ধ আত্মার অনুসন্ধান করেছেন, তার গানে ও ভাবাদর্শে সুফিবাদের ভাবধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আপনার আপনি চেনা যদি যায়।
তবে তারে চিনতে পারি
সেই পরিচয়।।

লেখকঃ সম্পাদক/প্রকাশক সাপ্তাহিক ‘সময়ের দিগন্ত’, আইনজীবী জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া ও এম.ফিল গবেষক।
E-mail: seraj.pramanik@gmail.com

অতিথি লেখক