প্রবাস থেকে একটি চিঠি…

প্রবাস থেকে একটি চিঠি…

রাহাত শিকদারঃ সাবাস বাংলাদেশ! এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়। জ্বলে পুড়ে ছারকার, তবু মাথা নোয়াবার নয়!! সাবাস তোমরা, অরুণ প্রাতের তরুন দল। সাবাস তোমাদের অদম্য একাত্মতা, সাবাস তোমাদের বিজয়ের অঙ্গীকার। সহস্র মাইল দূরে বসে যখন তোমাদের গর্জন শুনছি, শুনছি তোমাদের প্রতিবাদের প্রতিটি অক্ষর ঠিক তখনই আমার প্রতিবাদের রক্তচক্ষু বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে একফোঁটা আনন্দ অশ্রু। দেখছি আবাল বৃদ্ধ বনিতা আর এক ঝাঁক তরুণ তরুণীর চোখের ঝিলিক যার ক্ষিপ্রতায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে এ জাতির আজন্ম অভিশাপের ফসল যত নরপিশাচের দল। জনতার এই মঞ্চ যেন শুধু এক নরপিশাচই নয় সকল নরপিশাচদের ব্যাবচ্ছেদের মন্ত্র হয়। এই মঞ্চ থেকে গর্জে উঠুক আমরা পাক হায়েনাদের হত্যাযজ্ঞেরও বিচার চাই। শুধু বেজন্মা এই নরপিশাচদের বিচার নয় এইবার পাক হায়েনাদের গণহত্যার বিচারের দাবি পৌঁছে দিতে হবে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে। এই লাল সবুজের পতাকাতলে ঘোষিত হউক, লক্ষ শহীদের রক্তে স্নাত এই দেশের মাটিতে, দেশদ্রোহী কোন গোষ্ঠীর বা যে কোন অশুভ রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কোন ঠাই নাই। সকল দেশদ্রোহী গোষ্ঠীর রাজনীতির অধিকার আর রাজনৈতিক সমঝোতা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। আমি মোটেও বিস্মিত হইনি যখন তোমরা ওদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছ যারা এদেশের রাজনৈতিক ফায়দা নিয়ে দেশকে লুটেছে বারবার। তোমরা সজাগ থাকো যেন তোমাদের এই যাত্রা কোন তর্জনী ইশারায় রনেভঙ্গ না হয়ে যায়। জেগে ওঠো হে বাঙালি জেগে ওঠো বাংলাদেশ। আর কোন ধোঁকাবাজের রাজনীতি নয়। প্রজার সমষ্টি গড়ে তুলবে রাজার নীতি। এখনই দ্যর্ত কণ্ঠে ঘোষিত হউক আমরা আর দেখতে চাইনা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, গণতন্ত্রের নামে পরিবারতন্ত্র, রাজনীতির মুখোশ পরা অসাধু ব্যাবসায়ি, মোসাহেবি সুশীল সমাজের দল, লেজুড়বৃত্তি ছাত্ররাজনীতি ও কুলাঙ্গার ছাত্রের শিক্ষা সন্ত্রাস, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিক আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় লালিত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সন্ত্রাস। গণতন্ত্রের নামে যে রাজনৈতিক উত্তরসূরিগণ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঘটিয়েছেন তাদের এখনই বয়কটের ঘোষণা দিতে হবে। বিগত ৪১ বছরেও কালো টাকা আর উত্তরাধিকারের রাজনীতি পরিহার করে রাজনৈতিক শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠা না হবার পেছনে দায়ী কারা। এই প্রশ্নের ঝড় তুলতে হবে এই মঞ্চ থেকেই। সেদিন যে স্বাধিকারের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সাত কোটি মানুষের মাঝে, আজকের এই জনতার মঞ্চ তারই পথিকৃৎ। তাই আমি জনতার এই মঞ্চে দাড়িয়ে প্রশ্ন করতে চাই যে স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে কেন আজ জননিরাপত্তা আর আইনের শাসন তথাকথিত রাজনৈতিক খোলসে জিম্মি হয়ে আছে। কেন আজ স্বাধীনতার স্বাদ ফিকে হয়ে গেছে। কেন আজকে কালো টাকা, দুর্নীতি আর সন্ত্রাস রাজনীতির একমাত্র হাতিয়ার হয়ে গিয়েছে। স্বাধীন দেশে নাগরিক স্বাধীনচেতাকে কেন পরাধীনতার শিকল পরে থাকতে হবে। কলম সৈনিক দম্পত্তি সাগর-রুনি, মেধাবী ছাত্রি সনি, অবুঝ শিশু রাব্বি আর পরিবারের একমাত্র অবলম্বন বিশ্বজিৎ সহ হাজার মানুষ বিনা ওজরে কেন না ফেরার দেশে চলে গেল। কালো টাকা, হত্যা, দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের ডিগ্রী নিয়ে যখন রাজনৈতিক আশ্রয় মিলে যায় এবং অহরহ লোকেরা বনে যায় সমাজপতি তখন গনতন্ত্র আর নাগরিক সভ্যতার অস্তিত্ব বেঁচে থাকে বলে কোন সভ্যতার ইতিহাসে লেখা নেই। তাইতো নির্বিবাদে ঘটে চলেছে হাজার হাজার জানা অজানা নির্মম হত্যাকাণ্ড আর নাগরিক বিভীষিকা। লজ্জায় মুখ ঢেকে যায় যখন দেখা যায় দেশের সর্বচ্চ আদালত প্রাঙ্গনে আইনজীবী ও মাননীয় বিচারকদের মাঝে রাজনৈতিক বিভাজন হাতাহাতি এমনকি ঢিল ছোড়া পর্যায় পৌঁছে যায়। সকল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো মহান মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও পুনর্বাসন নিয়ে যখন ঘৃণ্য রাজনীতিতে মত্ত ঠিক তখনই রাজ্জাকের মতন অনেক মুক্তিযোদ্ধা পেটের দায়ে ঠেলাগাড়ি ঠেলে জীবিকা নির্বাহ করে যাচ্ছে। এই কষ্ট আমাকে কাদায় না যখন হতবাক হয়ে দেখি রাজনৈতিক পরশ্রীকাতরতার কাছে আমাদের দেশের মহান স্বাধীনতার স্বপ্নকে বেচে দিয়ে তোমরা নেশার ঘোরে পড়ে আছো। তাই তোমারদের দেয়া মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা নামক সুখের কাঁটা কখনওই সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের কাম্য নহে। এই জনতার মঞ্চে তাই সকল স্বৈরাচার আর কু রাজনীতির হোতাদের বয়কট করতে হবে। অপ রাজনীতির যে অসহ ধারা আমাদের এই দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে তার ব্যত্যয় ঘটাতে হবেই হবে। আমলা আর অসাধু ব্যাবসায়িদের কালো টাকার দৌরাত্ব থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে।
আমি স্বাধীনতার সেই বিভীষিকাময় রাত না দেখলেও তার চেতনা বিনম্রচিত্তে বুকে লালন করি। কেননা আমার পিতা মহান মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধের পরিচয় না নিয়েই এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। রেখে গেছেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম, আর তার রক্ষার দায়ভারও দিয়ে গেছেন আমাদের। স্বাধীনতার তিন যুগ পেরিয়ে আজ যারা আমার বনের ইজ্জৎহানি ঘটায়, সমাজে ব্যাভিচার ঘটায়, যারা হত্যা সন্ত্রাস চাঁদাবাজি দিয়ে সমাজকে জিম্মি করে রাখে, যারা অসাধু ব্যাবসা করে কালো পাহাড় গড়ে তোলে, যে আমলারা রাজনৈতিক মুসাহেবি করে দুর্নীতির জাল ছড়ায়, যারা রাজনৈতিক মুখোশ পরে সকল কুকর্মকে গোপন রাখে তাদের বিচার চাই। ভাষণ আর দলিল দস্তাবেজ এ নয়, চাই সত্যিকারের জননিরাপত্তা আর আইনের শাসন। আর চাই জাতির মহান সন্তান মহান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত স্বীকৃতি আর পুনর্বাসন। আরেকটি আন্দোলনের ফলশ্রুতি যেন সকল রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ইতি ঘটিয়ে বয়ে আনে রাজনৈতিক শিষ্টাচার। দেশদ্রোহ – সন্ত্রাস – দুর্নীতি – কালো টাকা যেন আর কোন রাজনৈতিক পরিচয়ে মুখ লুখিয়ে না রাখে। বিচার ব্যাবস্থা যেন কার ব্যাক্তগত সম্পদ না হয়ে ওঠে। আইনের শাসন যেন সকল সাধারন জনগনের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়। আইনের রক্ষক যেন ভক্ষক হয়ে সাধারনের উপর আর প্রভুত্ব না করে।
উপরোক্ত আলোচনা বিশেষ কোন প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলকে বা ব্যাক্তি বিশেষের উদ্দেশ্যে না হলেও এর দায়ভার স্বাধীনতা পরবর্তী সকল ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলীও রাজনৈতিক দলের। তাই এই সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে নিতিগত আমুল সংস্কার ও ভিশনের পরিবর্তন না ঘটালে এদেশের প্রকৃত গনতন্ত্র এবং স্বাধীনতার স্বাদ সাধারন নাগরিকের জন্য এক অলীক স্বপ্নই হয়ে থাকবে।

লেখকঃ রাহাত শিকদার
গবেষক, সাংবাদিক ও লেখক  
(বর্তমানে আফগানিস্থান সরকারের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বরত)

rahat0481@yahoo.co.uk

অতিথি লেখক