ভেলেন্টাইন্স ডেঃ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হোক এ ধারা…!

ভেলেন্টাইন্স ডেঃ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হোক এ ধারা…!

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ

 

১৪ ফেব্রুয়ারী। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। পাশ্চাত্যের ভেলেন্টাইন্স ডে কে কেন্দ্র করে ভালোবাসার এই বিশেষ দিনটি আমাদের বাংলাদেশেও উৎসব হিসেবে পালিত হয়। তবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই দিনটির আবেদন কিছুটা বেশি। জানা যায়, গত বছর ভেলেন্টাইন্স ডে উপলক্ষে বিট্রিশরা প্রায় ২২ মিলিয়ন ডলারের ফুল কিনেছিল। সারা বিশ্বে এই দিনে ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ লাল গোলাপ বিক্রি হয় প্রায় ১১০ মিলিয়ন ডলারের। ইউরোপে ১৪ ফেব্রুয়ারীকে কেন্দ্র করে সপ্তাহব্যাপী নানান অনুষ্ঠানের কর্মসূচি গৃহীত হয়। বাংলাদেশেও এই দিনটির তাৎপর্য ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে। কমতে শুরু করেছে ভালোবাসা সম্পর্কিত ভিন্ন মত বা ভিন্ন পথের জটিলতা। ভালোবাসা প্রতিটি দিনের, প্রতিটি ক্ষণের। মানুষের মধ্যকার অর্ন্তনিহিত ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভেলেন্টাইন্স ডে’র গুরুত্ব অপরিসীম। ভেলেন্টাইন্স ডে’ কে কেন্দ্র করে একটি শ্লোগানও তৈরী করা হয়েছে। সেটি হলোঃ ’’কৌতুক নয়, এসো ভালোবাসায় জীবন গড়ি।’’ পাঠকদের প্রতি রইলো ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা।

 

প্রেম ভালোবাসার বিষয়টি অনেকটাই ভাব বা চেতনার ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে চোখের দেখা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রথমে দেখা, সেখান থেকে আবেগ সৃষ্টি, অতঃপর প্রেম। প্রেম সম্পর্কে এটিই হচ্ছে সাইকোলজির সর্বশেষ ব্যাখ্যা। তবে চোখের দেখার পাশাপাশি মতিস্কের চিন্তা-ভাবনা, বন্ধুর প্রতি দৃষ্টি ভঙ্গি, মানবতাবোধ, এই সব কিছু মিলেই মানব হৃদয়ে সৃষ্টি হয় প্রেম বা ভালোবাসা। দার্শনিক দৃষ্টি কোন থেকে বিবেচনা করলে প্রেমের ক্ষেত্রে সব সময় শারিরীক সম্পর্ক প্রাধান্য পায় না। প্রেম বড়ই রহস্যময়। এই প্রেম নিয়ে কতো রম্য রচনা, গান, কবিতা, উপন্যাস তৈরী হয়েছে। তৈরী হয়েছে গল্প, প্রবন্ধ, আরো কতো কি! কিন্তু আজো এই বহুরূপী প্রেম-ভালোবাসার সঠিক ব্যাখ্যা আবিস্কার করা যায়নি। ভালোবাসা সম্পর্কিত সর্বাধুনিক সংগাটি হচ্ছে ‘‘হৃদয়ের স্বচ্ছ সরোবরে ভাবের তরণীকে প্রস্ফুটিত করাকেই বলে ভালোবাসা’’। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, প্রাচীন ইতালীর রোম শহরে মেয়েরা একটি বিশেষ দিনে ভালোবাসার কাব্য লিখে জমা করতো বিশেষ ধরণের একটি মাটির পাত্রে। সেই পাত্র থেকে সূর্যাস্তের পূর্বেই বিবাহযোগ্য যুবকদের একটি পত্র তুলতে হতো। বলা বাহুল্য যে, যেই যুবকের হাতে যেই পত্র উঠতো তাকে সেই পত্রের কাব্য লেখিকাকেই বিয়ে করতে হতো। বিষয়টি ছিলো সম্পূর্ণ ভাগ্যপ্রসূত। অর্থাৎ একটি বিশেষ দিনে বিবাহের এই অভিনব কৌশল অবলম্বন করা হতো। আর ঐ বিশেষ দিনটি ছিলো ১৪ ফেব্রুয়ারী। ভেলেন্টাইন্স ডে এতো আয়োজন ও উৎসবের সাথে পালন করা হলেও এর সঠিক উৎপত্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন ধারণা পাওয়া যায়নি। দিন ও কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে ভালোবাসা দিবস নিয়ে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের শ্রুতি মধুর গল্প। এই সকল শ্রুতি মধুর গল্পের অধিকাংশই ভিত্তিহীন। প্রচলিত গল্পের আলোকে জানা যায়, ২০০ খিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইতালীর রোম শহরে সেন্ট ভেলেন্টাইন নামে দু’জন স্বঘোষিত রাজার আর্বিভাব হয়। এই দুই রাজার মধ্যে প্রেম নিয়ে নানাবিধ বিরোধের সৃষ্টি হয়। প্রথম সেন্ট ভেলেন্টাইনকে দ্বিতীয় সেন্ট ভেলেন্টাইন ২৬৯ খিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারী নির্মম ভাবে হত্যা করে। এই হত্যার অন্তরালে প্রধান চিহ্নিত কারণ ছিলো তিনি এক সুন্দরী যুবতীর প্রেমে মগ্ন হয়ে রাজ্য পরিচালনায় ব্যর্থ হচ্ছিলেন। প্রথম সেন্ট ভেলেন্টইনকে হত্যার পর দ্বিতীয় সেন্ট ভেলেন্টাইন রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতার অধিশ্বর হন। ক্ষমতার দাপটে সেই রাজা তাঁর রাজ্যে নিয়োজিত সব সৈনিকের কোন রমণীর সাথে মেলামেশা এমনকি বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আরো ঘোষণা করা হয়, যে সৈনিক বিবাহে আগ্রহ প্রকাশ করবে তাকে তাৎক্ষণিক ভাবে হত্যা করা হবে। সৈনিকদের প্রতি রাজার এরূপ অত্যাচার দেখে স্রষ্টার খুব করুণা হয়। তিনি নিজেই ‘দেবী’ রূপে পৃথিবীতে আর্বিভূত হন এবং আপন মহিমায় মহিমান্বিত করে বর্বর রাজা দ্বিতীয় সেন্ট ভেলেন্টাইনকে প্রেমে আশ্বস্ত করেন। তাদের এই প্রেম ১৪ ফেব্রুয়ারী বিবাহে রূপ লাভ করে। বিয়ের পর রাজা অনুধাবন করতে পারেন যে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য মানব হৃদয়ে প্রেম ও ভালোবাসার ভূমিকা কতোটা অপরিসীম! পরবর্ত্তীতে তিনি সৈনিকদের উপর থেকে প্রেম এবং বিবাহ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। সৈনিকদের মনে ফিরে আসতে শুরু করে শান্তির পরশ। ফলে সেই দিনটিকে চির স্মরনীয় করে রাখার জন্য সেন্ট ভেলেন্টাইনের নামানুসারে ১৪ ফেব্রুয়ারীকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্ত্তীতে প্রথম পোপ জুলিয়াস ৪৯৬ খিষ্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারীকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ভেলেন্টাইন্স ডে কে ঘিরে এসকল শ্রুতি মধুর ঘটনার কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু বিশ্বের প্রেমিক-প্রেমিকারা এই দিনের মমার্থ লালন করে গভীর আগ্রহে এবং আন্তরিকতায়। অনেকের উপলদ্ধি, ভালোবাসা দিবসে দু’জন দু’জনকে একান্তে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা শক্তিকে প্রবল করে। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার আকর্ষনে উদ্ভুদ্ধ করার মনোবাসনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে ভালোবাসা দিবস তথা ভেলেন্টাইন্স ডে।

 

ষোড়শ শতকে শুরু হয় আধুনিক ভেলেন্টাইন্স ডে’র রীতি। তরুণ-তরুণীরা মনের মানুষের কাছে এ দিনটিতে প্রেম নিবেদন করে। জানায় প্রণয় সম্ভাষন। প্রথম দিকে মনের কথা পাঠানো হতো তামার পাত বা কাঠের ফলকে খোদাই করে। ১৯৩৬ সাল থেকে কাগজের চিঠি বা প্রেমের কার্ড পাঠানোর রেওয়াজ শুরু হয়। জানা যায়, রোমের ইএম ক্রুমক্রিয়াতিকে দেয়া হয় প্রথম ভালোবাসার কার্ড। আমাদের বাংলাদেশে মূলত ১৯৯৮ সাল থেকে ভেলেন্টাইন্স ডে’র তাৎপর্য উজ্জীবিত হতে থাকে। পাশ্চাত্যের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্বায়নের এ যুগে ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্র এবং মাধ্যম সবই এখন ভিন্ন আঙ্গিকে পালিত হয়। একটা সময় ছিলো যখন প্রেম নিবেদনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসেবে নীল খামে ভরা চিঠিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হতো। ভালোবাসার নিদর্শন ছিলো সতেজ ফুলের কমল স্বর্শ। এখন ডিজিটাল যুগের প্রভাবে সে সবের অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটেছে এবং ঘটছে। এখন ভালোবাসার শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো হয় মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমে। উপহার হিসেবে দেয়া হয় নানান ধরণের গিফ্ট হ্যাম্পার। আমাদের দেশীয় বুটিক হাউজ গুলো ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে তৈরী করছে চমৎকার সব পোষাক। কে-ক্র্যাফট, ধানসিঁড়ি, সাদামন ও ফাল্গুণ ভেলেন্টাইন্স ডে কে সামনে রেখে ভিন্ন স্বাদ ও ডিজাইনের বিচিত্রধর্মী পোষাক নির্মাণ করে। এই বিষয়ে পিছিয়ে নেই গিফ্ট শপ গুলোও। আর্চিস্, হলমার্ক সহ অন্যান্য গিফ্ট শপগুলোও বৈচিত্রতার নিদর্শন রেখে তৈরী করেছে নানাবিধ উপহার সামগ্রী। বিভিন্ন রেষ্টুরেন্ট গুলোতে সাজ-সজ্জায় আনা হয়েছে রকমারি পরিবর্তন। মোমবাতি জ্বালিয়ে তাজা ফুলের সুবাসে অন্ধকারাছন্ন পরিবেশে ভালোবাসার আবেগকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতে এই সকল রেষ্টুরেন্ট গুলো অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। সম্প্রতি একটা বিষয় বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত। সেটি হলো মিডিয়ায় ভেলেন্টাইন্স ডে কে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করা হচ্ছে বিবিধ আয়োজন। ফেব্রুয়ারী মাসের শুরু থেকেই পত্র-পত্রিকা তথা প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভালোবাসা দিবস সম্পর্কিত হরেক রকম লেখা, মতবাদ, স্মৃতিচারন, নাটক, টক-শো প্রভৃতি প্রকাশ এবং প্রচার করা হচ্ছে। এই সব ক্ষেত্রেই একটি জিনিসকে প্রধান্য দেয়া হচ্ছে। সেটি হলো ‘ভালোবাসা’ শব্দটিকে শুধুমাত্র একটি বিশেষ শ্রেণী অর্থাৎ প্রেমিক-প্রেমিকা বা নারী-পুরুষের গন্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে ভালোবাসা হচ্ছে মানুষ মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও আন্তরিকতার নিদর্শন। বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা, মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা কিংবা একে অন্যের প্রতি যে কমিটমেন্ট, সেগুলোকেও ভালোবাসা দিবসের অর্ন্তভুক্ত করা আবশ্যক। আমরা যারা পত্র-পত্রিকায় লেখা-লেখি করি তাদের অনেককেই কর্মের স্বার্থে অনেকের-ই বিরাগভাজন হতে হয়। একই সাথে অনেকের-ই প্রশংসার পাত্রও হতে হয়। এক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে আমাদের মনে আবেগের সঞ্চার হয়। যান্ত্রিক এ জীবনের চলার পথে আমাদের এই আবেগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থেকে যায় অপ্রকাশ্য। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। থেমে থাকে না ঘড়ির কাঁটা। শুধুমাত্র সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় জীবনের চলার পথের রীতি। বদলে যায় জীবনের রং। বেঁচে থাকার অভিলাষে জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে আমাদেরকে সামনের দিকে ছুটে চলতে হয়। আর সামনে এগিয়ে চলার জন্য যে জিনিসটির গুরুত্ব অপরিসীম, সেটি হচ্ছে মানুষের ‘ভালোবাসা’।

 

ভালোবাসা সার্বজনীন। ভালোবাসা চিরন্তন। সকল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, সকল প্রাণের মাঝে রয়েছে ভালোবাসার ব্যাপ্তি। আমাদের সৌভাগ্য আমরা বছরের এমন একটি দিন আবিস্কার করতে পেরেছি যে দিনটি ভরে থাকবে শুধু ভালোবাসায়। আমাদের মনের সকল হিংসা-বিদ্বেষ ভূলে গিয়ে আমরা কি পারি না আমাদের সমগ্র হৃদয়কে ভালোবাসায় ভরে রাখতে? শুধু একটি দিনই নয়। এরকম ১৪ ফেব্রুয়ারী আমাদের জীবনের প্রতিটি পদে, প্রতিটি মুর্হূতে ফিরে ফিরে আসুক। অম্লান ভালোবাসায় ভরে থাকুক আমাদের যান্ত্রিক জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ। সর্বশেষে ভালোবাসার এই মহেন্দ্র ক্ষণে স্মরণ করছি আমার প্রয়াত বাবাকে। যার অনুপস্থিতি আমার প্রতিটি অসহায় মুর্হূত্বের নীরব স্বাক্ষী। আমার হৃদয়ের সিক্ত স্পন্দনের মাধ্যমে বাবার প্রতি আমার অশেষ ভালোবাসা প্রকাশ করছি। ‘‘হ্যাপি ভেলেন্টাইন্স ডে বাবা…!’’

 

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।।

 

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।