জাল দলিল সম্পাদন ও আইনগত প্রতিকার

জাল দলিল সম্পাদন ও আইনগত প্রতিকার

সিরাজ প্রামাণিকঃ দেশের প্রচলিত আইনে জমির দলিল সম্পাদনে এক ধরণের বাধ্যবাধকতা প্রদান করা হয়েছে। আর এ দলিলই মূলত একটি জমির আইনগত ভিত্তি। কিন্তু এ জমি-জমা সংক্রান্ত দলিলসহ বিভিন্ন দলিলের জালিয়াতির ঘটনাও অহরহ ঘটছে এবং এ সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। জালিয়াতির মাধ্যমে কোনো দলিল সম্পাদন করে লোক ঠকানো, প্রতারণা বা অন্যায়মূলক কাজে সহায়তাদান আইনের দৃষ্টিতে একটি গুরুতর অপরাধ।
বাংলাদেশে প্রচলিত দণ্ডবিধি আইনের ৪৬৩ ধারার বিধান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, জালিয়াতির অপরাধের আবশ্যকীয় উপাদান দুটি, প্রথমতঃ মিথ্যা দলিল প্রস্তুত করা, দ্বিতীয়তঃ প্রতারণামূলক ইচ্ছা নিয়ে কোন ব্যক্তিকে ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে উহা করা। দণ্ডবিধির ৪৭০ ও ৪৭১ ধারা অনুযায়ী, জাল বা মিথ্যা দলিল হচ্ছে, যে দলিল জাল প্রক্রিয়ায় সম্পাদন করা হয়েছে। এবং যদি কোনো ব্যক্তি প্রতারণামূলকভাবে কোনো জাল দলিল জেনে শুনে মূল দলিল হিসেবে ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি দায়ী হবেন এবং দলিল জালিয়াতির অপরাধে দন্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধির ৪৬৪ ধারায় মিথ্যা দলিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্রথমত, কোনো দলিল কিংবা অংশবিশেষ এমন ব্যক্তি কর্র্তৃক প্রণীত স্বাক্ষরিত, সিলমোহরকৃত বা সম্পাদিত বলে বিশ্বাস জন্মানোর উদ্দেশ্যে, যা প্রকৃত ব্যক্তি কর্তৃক সম্পাদিত হয়নি; দ্বিতীয়ত, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক দলিল সম্পাদিত হওয়ার পর প্রতারণামূলকভাবে বাতিল করে; তৃতীয়ত, যদি কোনো ব্যক্তি প্রতারণামূলক কোনো মাতাল বা মানসিক বিকারগ্রস্থ ব্যক্তি দ্বারা কোন দলিল স্বাক্ষরিত, সিলমোহর বা পরিবর্তন করান, যা বুঝতে অক্ষম, তা হলে এ ক্ষেত্রগুলোতে দলিল জালিয়াতি করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। এ ধারার দুটো ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি তাঁর নিজ নাম স্বাক্ষর করলেও যদি অন্য ব্যক্তির স্বাক্ষর হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে জালিয়াতি হতে পারে। মৃত লোকের নামে মিথ্যা দলিল প্রণয়ন করা হলে জালিয়াতি হিসেবে গণ্য হবে। মনু মিয়া বনাম রাষ্ট্র (৪২ ডিএলআর ১৯১) মামলায় বলা হয়েছে, কোনো দলিলকে জাল বলতে হলে অবশ্যই তা অসৎ ও প্রতারণার উদ্দেশ্যে সম্পাদিত হতে হবে। যেমনঃ কামাল মামুনকে ৫০০/-টাকার একটি চেক দেয়, আর মামুন উহাতে আরও একটি বাড়তি শূণ্য (০) বসিয়ে ৫,০০০/- টাকা লিখে ব্যাংকে উপস্থাপন পূর্বক উক্ত টাকা গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় মামুন জালিয়াতি করেছে বলে গণ্য করা হবে। কেননা অপরকে প্রতারিত করার অসৎ উদ্দেশ্যে কোন দলিল সম্পাদন করলে উহাকে জালিয়াতি বলা যায়।
দণ্ডবিধির ৪৬৫ ধারায় জালিয়াতির শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি জালিয়াতি করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি দু বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডসহ উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। ৪৬৬ ধারা অনুযায়ী আদালতে নথি বা সরকারি রেজিষ্টার ইত্যাদিতে জালিয়াতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বিচারালয়ের নথিপত্র বা মামলার বিবরণী বলে গণ্য কোনো দলিল বা জন্মনামকরণ বিয়ে বা শবসংক্রান্ত রেজিষ্টার হিসাবে গণ্য বা বা সরকারি সার্টিফিকেট জাল করেন অথবা মামলার কোনো রায়ের কপি জাল করেন, তাহলে দায়ী ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ডসহ অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। এ অপরাধ জামিনযোগ্য নয়। ৪৬৭ ধারানুয়ায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি মূল্যবান জামানত, উইল প্রভৃতি জাল করেন, তাহলে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ অর্থদন্ডে দন্ডিত হেেবন। ১৯ ডিএলআর ৮৬২-এর মতে, ৪৬৭ ধারার অধীন দণ্ডনীয় অপরাধ এ রকম জালিয়াতিতে সহায়তার কারণেও হতে পারে। ৪৭৪ ধারায় বলা  হয়েছে, ৪৬৬ ও ৪৬৭ ধারানুযায়ী প্রতারণার উদ্দেশ্যে জালিয়াতির জন্য সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ জরিমানার বিধান আছে।

জালিয়াতির প্রতিকার দেওয়ানি আইনে চাইলে দন্ডবিধি আইনে মামলা চলবে না একই বিষয়ে দুটি পৃথক আদালতে মামলা-মোকদ্দমা চলবে না। কারণ এতে রেস-জুডিকাটা দোষে মামলাটি বাতিল হতে পারে বা এর গুণাগুণ নষ্ট হতে পারে। তবে জালিয়াতি-সংক্রান্ত কোনো কারণে যদি দেওয়ানি আদালতে দলিল বাতিলসহ স্বত্ব দখলের প্রতিকার কিংবা এ মর্মে ঘোষণামূলক প্রতিকার চাওয়া হয়, তবে ফৌজদারী আদালতে জালিয়াতির সাজা প্রদানের জন্য পৃথক মামলা করা যাবে কি-না, এসম্পর্কে নির্দিষ্ট বিধিবিধান রয়েছে। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৯৫(১) ধারানুযায়ী, কোনো আদালত এমন কোনো অপরাধের প্রতিকার আমলে নেবেন না, যা কোনো দলিল সম্পর্কে কোনো অপরাধ সংঘটিত করেছে বলে অভিযোগ করা হয়, যা কোনো আদালতে বিচারধীন। অর্থাৎ জালিয়াতি সংক্রান্ত কোনো বিচার কার্যচলাকালে আদালতের লিখিত অভিযোগ ব্যতীত কোনো দলিল জালিয়াতি-সংক্রান্ত ধারার অধীন অপরাধের বিচার অন্য আদালত করতে পারেন না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দলিল জালিয়াতির কারণে কোনো প্রতিকারের ক্ষেত্রে দেওয়ানি মোকদ্দমা চললে শুধু ওই আদালতের লিখিত অভিযোগ ছাড়া কোনো ফৌজদারি মামলা চলে না। বিচারাধীন আদালতের লিখিত অভিযোগের মাধ্যমে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেটই ওই অপরাধ আমলে নিতে  পারেন।
লেখক: সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী।।

অতিথি লেখক