কষ্টের কালোমেঘ সরাতে নারীর রঙধনুময় বাজেট

কষ্টের কালোমেঘ সরাতে নারীর রঙধনুময় বাজেট

বাজেট মানেই মন্ত্রী এমপি আর আমলাদের বেতন বৃদ্ধি, নতুন গাড়ি, সুন্দর বাড়ি। এই তথাকথিত বাজেটের বাইরে এসে বাংলাদেশকে গড়তে ভূমিকা রাখতে হবে। গড়ে তুলতে হবে নারী-পুরম্নষের বৈষম্যমুক্ত সকলের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। যে দেশে নারী মানেই নতুন মত নতুন পথ হতে পারে, হতে পারে প্রত্যয়ের সাথে হাঁটা সাহসসময় আর আলোকিত পথ। আর সেই সুখ-স্বাচ্ছন্দিত আনন্দিত আগামীর নারী বান্ধব বাজেট নিয়ে লিখেছেন-  মোমিন মেহেদী।

নারী, স্বপ্ন দেখায় স্বপ্ন শেখায় এবং অনবরত তৈরি করে রঙধনুর মত করে/ কেননা, চারপাশে কালোমেঘের আনাগোনা থাকে সবসময়…কবির এই কবিতা যতটা উৎসাহের বীজ বোনে নারীর জন্য; ঠিক ততটাই হতাশার বজ্রপাত চলে প্রতিনিয়ত আমাদের পরিবার, সমাজব্যবস্থা, দেশ এবং জাতীয় সংসদের বাজেট। অথচ আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নারী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী নারী এমন কি সংসদের হুইপ পর্যমত্ম নারী; তারপরও বেড়েছে নারী-পুরম্নষ বৈষম্য। ক্রমশ আমরা এগিয়ে যাচ্ছি অন্ধকারের দিকে। আর এই সুযোগে নারীর প্রতি প্রতিনিয়তই কঠোর হয়ে উঠছে আমাদের জাতীয় সংসদ, প্রশাসনসহ সকল সত্মরের পুরম্নষেরা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় জাতীয় বাজেটের কথা। প্রতিটি বাজেটে নারীর জন্য জীবন-মরনের প্রশ্নবোধক চিহ্নটি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে পচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে। তারই ধারাবাহিকতায় চলছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যর মাধ্যমে জানা যায় যে,  গত পাঁচ বছরে বাজেটে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ কমেছে ৫০ শতাংশ। জাতীয় বাজেটে নারী উন্নয়নে গত ৫ বছরে বরাদ্দ কমেছে ৫০ ভাগ। এ সময় শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি। তার বিপরীতে কাজ পাচ্ছে না ৫ দশমিক ৮ ভাগ নারী শ্রমিক। এমনকি জাতীয় আয়ে আনুষ্ঠানিক সেক্টরে একজন কর্মজীবী নারী পুরম্নষ শ্রমশক্তির মজুরির মাত্র ৫২ শতাংশ এবং অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে ২৯ শতাংশ মজুরি পায়। অথচ কৃষি ও অকৃষি উভয় শ্রমেই নারীর প্রকৃত অবদান পুরম্নষের তুলনায় বেশি। অন্যদিকে পেটে-ভাতে কাজ করছে ৯১ লাখ নারী শ্রমিক। তার মধ্যে শহরে ১৮ লাখ এবং গ্রামে ৭৪ লাখ কাজ করে। গত দুই দশকে পুরুষের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার যেখানে স্থির হয়ে আছে, সেখানে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ১৯৯৫-৯৬ সালে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ হতে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১০ সালে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এমডিজির লক্ষ্য ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে অকৃষি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো। কিন্তু গত ১০ বছরে অকৃষি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার হ্রাস পেয়ে, কৃষি খাতে বেড়েছে। জমিতে মালিকানা না থাকার কারণে কৃষিতে ও অংশগ্রহণের সুফল তারা পাচ্ছে না। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারী উন্নয়নের জন্য কাজ করলেও তাঁর স্বপরিবারের নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকে নারী উন্নয়নের জন্য আশানুরম্নপ কাজ হয়নি। বিশেষ করে বলা যায়,  নারীর নিজস্ব দারিদ্র্যবিমোচন প্রাধান্য পায়নি। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে নারীর দারিদ্র্য নিরসনের কাঠামোগত কোনো বিন্যাসও  কোন বাজেটে পরিলক্ষিত হয়নি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি-কোথায়, কার মাধ্যমে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে তার ও কোনো দিক নি©র্দশনাও বাজেটে নেই। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দলিলে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে নারীকে স্বনিয়োজিত পেশায় নিয়োজিত করাই দারিদ্র্যবিমোচনের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা হলো। দেখা গেছে ২০০১-২০০২ অর্থবছরে মোট ১০টি ক্ষেত্রে শুধু নারীর জন্য বরাদ্দ ছিল। কিন্তু ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে বেশ কয়েকটি গুরম্নত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারীর জন্য বরাদ্দ তুলে নেয়ায় প্রকল্প সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬টি। ১০ বছরের বাজেট বিশেস্নষণ করলে দেখা যায়, কেবল নারীকে লক্ষ্য করে গ্রহণ করা প্রকল্পের সংখ্যা ও বাজেট বরাদ্দ দুই-ই ধীরে ধীরে কমে  গেছে। ৭০ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রসত্মাবিত উন্নয়ন বরাদ্দে প্রতি বছরই সংশোধিত বাজেটে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে এসেছে এবং তা গত ৫ বছরে কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে । ২০০৪-২০০৫-এ কেবলমাত্র নারী উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল শতকরা ২ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু ২০১১-২০১২ অর্থবছরে বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ১ দশমিক ০৬ শতাংশ। গত কয়েক বছরের মোট বাজেট বরাদ্দ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবিত বাজেটের মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায়, ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরের মোট বাজেটের মধ্যে ওই মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ দশমিক ১১ শতাংশ । সেখানে ২০১১-২০১২ অর্থবছরে বাজেটের মধ্যে ওই মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নারী উন্নয়নের শর্ত হিসেবে নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ ও লাভজনক করার জন্য উন্নয়ন বাজেটে দরিদ্র নারীর জন্য কোনো প্রকল্পের কথা বলা নেই। যেমন শিল্পখাতের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে চলতি অর্থবছরে নারীর জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। যা ২০০০ সাল থেকে ২০১০ অর্থবছর পর্যন্ত এ খাতে নারীর জন্য বরাদ্দ ছিল শতকরা ৭ শতাংশ। অথচ বর্তমানে শিল্পখাতের মোট শ্রমিকের মধ্যে শতকরা ৭০ শতাংশ নারী শ্রমিক কাজ করে। শিল্পখাতে কমর্রত নারী শ্রমশক্তি পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে ৩৫ শতাংশ মজুরি কম পান। ব্যাপক বৈষম্যের কারণে জাতীয় আয়ে নারীর অবদান সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। এছাড়াও শ্রমশক্তির জরিপ অনুযায়ী মোট শ্রমশক্তির কৃষিতে শতকরা ৭৩ দশমিক ৬ শতাংশ নারী শ্রমজীবী রয়েছে। তবে জাতীয় আয়ে এর মধ্যে মাত্র ২৫ লাখ নারী কাজের মর্যাদা পাচ্ছে। শিক্ষায় ও নারীর মজুরির হার বাড়াতে পারেনি। বাংলাদেশ গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় রয়েছে যে, গত ৭ বছরে গার্মেন্ট শিল্পে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ হারে। অথচ এ সময়ে ৩০ শতাংশ হারে বেতন বাড়ার কথা ছিল। এমনকি বিজ্ঞান ও কারিগরির মতো গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরেও চলতি বছরে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। ফলে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তাদের আয় বাড়েনি। গবেষণায় দেখা গেছে, নারীর জন্য যে প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়। তার প্রত্যেকটিই হয় দাতাগোষ্ঠী দ্বারা নির্বাচিত নয়তো সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তি দ্বারা নির্বাচিত। নারীর প্রকৃত প্রয়োজন কি-তা জরিপ করে কখনও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। তবে এনজিও ঋণ বাস্তবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে কতটুকু ভূমিকা রাখে -সে বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের মতভেদ রয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর মতে, তাদের কর্মকান্ড দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করছে। ঋণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারীরা আত্মকর্মসংস্থান, কৃষিজমি, পরিবহন, অকৃষি, খাত থেকে আয়, আয়বর্ধক, সম্পদ, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকে এবং নারীর ক্ষমতায়নেও ক্ষুদ্রঋণ বড় ভূমিকা রাখে। সরকার মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একের পর এক প্রকল্প বন্ধ করে দেয়ার পরও যে প্রকল্পগুলো রয়েছে, তাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবয়বের তুলনায় এসব কর্মসূচিতে বরাদ্দের পরিমাণ একেবারেই নগন্য। এমতবস্থায় যা প্রয়োজন তা হলো- ৫০ শতাংশ বঞ্চিতের প্রতি সরকারের মনোযোগ দেয়া।  যেহেতু আমাদের দেশের ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠীই নারী এবং যাদের সিংহভাগই সম্পদহীন, ক্ষমতাহীন এবং উপার্জনের সুযোগবঞ্চিত ও পরাধীন। নাগরিকদের এই অর্ধাংশকে পিছনে ফেলে রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, সম্ভব নয় প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চাও। এজন্য জাতীয় বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত সম্পদ ও ক্ষমতাহীন উলিস্নখিত ৫০ শতাংশ নারীর দিকে সম্পদ প্রবাহ বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবী। পাশাপাশি সুনির্দিষ্টভাবে আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করাটাও প্রয়োজন।  রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহের বাসত্মবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন, নীতিসমূহের সুষম বাসত্মবায়ন ও সুযোগসুবিধা বণ্টনে বৈষম্য নিরোধের জন্য সকল মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার-বিভাজিত তথ্যউপাত্ত প্রস্তুত করবার উদ্যোগ নেওয়াটাও বিশেষ জরম্নরী। আমরা জানি, ২০১০-’১১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ১০টি মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার বিভাজিত উপাত্ত উপস্থাপন করেছিলেন। এবার এই সংখ্যা আরো বাড়াবারও দরকার হয়ে আছে আলোকিত আগামী গড়ার লÿÿ্য। নারী উন্নয়ন নীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে পৌঁছতে হলে নারীর প্রজননভার কমিয়ে এনে সামাজিক ও উপার্জনমূলক কর্মকান্ডে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণের লক্ষ্যে স্বাবলম্বী নাগরিক হিসেবে বিকাশে নারীর জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য জরুরিভিত্তিতে নারীবান্ধব জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও সেবা, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের মতো কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সর্বত্র যাতে মানসম্পন্ন ও নিরাপদ জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা সহজলভ্য হয় সে ব্যাপারেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মাত্র সাড়ে সাত কোটি জনগোষ্ঠী ৪০ বছরে ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশিতে পরিণত হয়েছে। গত দশ বছরে জনসংখ্যার যে বৃদ্ধি ঘটেছে তার ৮৭ শতাংশই দরিদ্র। এর ফলে পরিবেশ, অর্থনীতি, কৃষিজমি, রাস্তাঘাট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, পানীয় জল, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, সরকারি সুযোগসুবিধা প্রাপ্তিসহ সর্বক্ষেত্রেই প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। নারীর জন্য শিক্ষায়, কর্মদক্ষতায় ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠবার সুযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে জনবিস্ফোরণের সংকটকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা যাবে। এমডিজি দলিলে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লক্ষে ১৪৪ জনে নামিয়ে আনবার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই লক্ষ্য অর্জনে অনেকটা পিছিয়ে আছে। ‘নারীনীতি ২০১১’ মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসের ওপর যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে। ২০১৫’র মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে নারীনীতি ২০১১’র ৩৪.৩ উপধারাটি অতি জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য নিদৃষ্ট কিছু ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। আর তা হলো- কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারের ঘোষণাটি অতি দ্রুত কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়া। দরিদ্র প্রসূতি মায়েদের জন্য মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিমের আওতা বৃদ্ধি করা। ধাত্রী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা। সরকারি-বেসরকারি যৌথউদ্যোগে ধাত্রী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাটি নতুনভাবে চালু ও আধুনিকীকরণ করা এবং ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের সকল হাসপাতালে জরুরি ধাত্রীসেবা কার্যক্রম চালু করা। গ্রামে গ্রামে ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক ব্যবস্থা চালু করা। নারীর জন্য সাধারণ, প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্য সেবা এবং নারীর শরীরের জন্য নিরাপদ জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা প্রদানের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রকল্প গ্রহণ করা। একই সাথে পুরুষদের উপযোগী জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সহজলভ্য ও তা ব্যবহারের প্রসার ঘটানের ব্যবস্থা নেয়া। সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলে যথাযথভাবে মাতৃস্বাস্থ্য ও প্রসূতি সেবা এবং মানম্পন্ন জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা পৌঁছানোর জন্য জেন্ডার পোভার্টি ম্যাপিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে নারী ডাক্তারের সেবা নিশ্চিত করতে তাঁদের বেতন বৃদ্ধি, বাসস্থান এবং চলাফেরার নিরাপত্তা বিধান করা এবং নারীর পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকিসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া।

কর্মসংস্থান ও কর্মস্থলে সমসুযোগ, অংশীদারিত্ব, সমমজুরি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়েও নিতে হবে বিশেষ বাজেট চিমত্মা।  কেননা, এই বিষয়গুলো এমডিজিরও অমত্মর্ভুক্ত। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন নারীর দক্ষতা বৃদ্ধি। দক্ষতা এবং সক্ষমতা না থাকলে শ্রমবাজারে সুযোগ দিলেও নারীরা তা গ্রহণ করতে পারবেন না। দক্ষতা এবং সক্ষমতার প্রশ্নে সরকারি চাকুরির ১৫ শতাংশ পদ, যা নারীর জন্য কোটা করে দেওয়া হয়েছিল তা এখনো পূরণ হয় নি। তাই নারীনীতি ২০১১-এর উলি­খিত ধারাগুলো কার্যকর করার জন্য বাজেটে প্রত্যয়ের কিছু পদক্ষেপগুলো প্রয়োজন। তা হলো- নারীকে উচ্চ প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা এবং বেসরকারি খাতকে এই ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনে প্রণোদিত করা। গ্রামাঞ্চলেও এসব সুযোগ প্রসারিত করা। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও অন্যান্য দেশে নারীকর্মীর যে চাহিদা রয়েছে সে চাহিদা পূরণ করতে অদক্ষ নারীদের প্রেরণ না করে ধাত্রী, নার্স ও অন্যান্য ক্ষেত্রের দক্ষকর্মী প্রেরণের ব্যবস্থা নেওয়া এবং বিদেশে নারীকর্মীদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় সংশি­ষ্ট দূতাবাসসমূহে নারীসংবেদী জনবল বৃদ্ধি করা ও কনস্যুলার সার্ভিসকে শক্তিশালী করা। দেশি ও বিদেশি কর্মক্ষেত্রে সুফল দেয়, এমন বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার জন্য নারীদের জন্য জেলা পর্যায় পর্যন্ত ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। ১০০ দিনের নিশ্চিত কর্মসূচি’র আদলে ‘১০০ দিনের নিশ্চিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি’ গ্রহণ করা। নারীদের মধ্যে যারা অতিশয় দরিদ্র, তাদের জন্য সেফটি নেট কর্মসূচিগুলোর পরিমাণ ও আওতা বৃদ্ধি করা এবং সকল বার্ধক্যপীড়িত নারীর জন্য বিমার ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে সন্তান বা অন্য কারো ওপর তাঁদের নির্ভরশীল থাকতে না হয়। নারীকর্মীদের জন্য যাতায়াত ব্যবস্থা, বাসস্থান, বিশ্রামাগার, পৃথক টয়লেট স্থাপনসহ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে বাংলাদেশ, সোনার বাংলাদেশ গড়ার মহান লÿÿ্য। যেমন- প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা। কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতকালে নারী কর্মজীবীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে থাকেন। তাঁদের নিরাপত্তা বিধানে প্রশাসনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা। পরিবহণ সুবিধা প্রদানের জন্য বিআরটিসি কর্তৃক সরবরাহকৃত বাসে নারী কর্মজীবীদের জন্য হ্রাসকৃত মূল্যে টিকেটের ব্যবস্থা করা। নারী কর্মজীবীদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য সরকারি উদ্যোগে বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র স্থাপন করা। নারীর উপস্থিতি বেশি এরকম কর্মস্থলে নারী কর্মজীবীদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা। নারীদের জন্য শিক্ষা ও শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করাসহ সকল বৈষম্য দূর করার মধ্য দিয়ে নারীর কষ্টের কালোমেঘ সরাতে বাজেট হোক নারীর রঙধনুময়। এমন প্রত্যয়ের বীজ বুনে সম্প্রতি মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট তারানা হালিম বলেছেন, আমার মতে নারীর জন্য সকল বাঁধা দূর করার ব্রতি নিয়ে বাজেট করা উচিৎ। অন্যদিকে নারী নেত্রী শিরীন আখতার বলেছেন,

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই বিশাল  জনগোষ্ঠী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সম্পদের মালিকানা, নীতি-নির্ধারণ ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও শ্রমের মূল্যায়নসহ সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার। এই বৈষম্য দূরীকরণে নারীর জন্য সরকারি প্রণোদনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই নারীর ক্ষমতায়নে ও নারী উন্নয়নে নারীর জন্য সুনির্দিষ্ট বাজেট এখন সময়ের দাবি। ২০১১-১২ অর্থবছরে নারীর ক্ষমতায়ন ও শিশু কল্যাণ খাতে ১ হাজার ২৪১ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, যেখানে নারীর কর্মসংস্থানের জন্য কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের বিচ্চৃতি, ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনার কথা বলা আছে। সরকার ইতিমধ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ ঘোষণার মাধ্যমে প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু এই নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করতে হলে বাজেটেও তার প্রতিফলন থাকতে হবে। নারীর উন্নয়ন ও জাতীয় বাজেটের ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা নারী নেত্রী রাশেদা কে চৌধুরী  বলেছেন, ‘বাসত্মবতা হচ্ছে, অঙ্গীকারে একরকম আর অর্থ বরাদ্দ, বিনিযোগের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম এবং এসব ক্ষেত্রে নারীর অগ্রাধিকার থাকছে না। নারীর উন্নয়নে সবগুলো বিনিয়োগ কমানো হলো। বিনিয়োগ কমানোর আগে সরকারের দেখা দরকার প্রকৃত অর্থে নারী উন্নয়নে কোথায়, কোন জায়গায় অগ্রাধিকার এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয় বাজেটে নারীর জন্য গ্রহণ করা প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য ও কর্মকান্ডের সঙ্গে নারীর প্রয়োজনের বাস্তব মিল থাকে না। আমরা মিল চাই। চাই চাওয়া অনুযায়ী পাওয়া পেতে। এÿÿত্রে সবার আগে প্রয়োজন নতুন দিনের রঙিন বাজেট নারীর জন্য। কেননা, নারী নতুন মত নতুন পথ ধরে হেঁটে চলেছে প্রত্যয়ের সাথে…

mominmahadi@gmail.com

অতিথি লেখক