আজ আমাদের বিজয়

আজ আমাদের বিজয়

আজ আমাদের বিজয়
তানজারীন ইফফাত স্বাতী

২০০১ সাল—-
“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”।

——–রাত হয়ে গেছে। বর্ষা বিছানায় শুয়ে। ভাবছে—-
আব্বু, বড় চাচ্চু আর দাদু মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আব্বু তো প্রায়ই আমাদের সেই গল্প বলে। ইস্ আমি যদি তখন হতাম। আমাদের দাদু মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধের কথা মনে হলেই বর্ষার শরীরের রক্ত শিরশির করে ওঠে। আর হবেই না বা কেন? ও যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। ওর বাবা দাদুর রক্তই তো ওর শরীরে বইছে।

কাল সকাল হলেই বিজয় দিবস। ১৬ই ডিসেম্বর। আজ চাচ্চু আমাদের অনেক গল্প শুনিয়েছে। কিভাবে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। ভাষা শহীদদের কথা বই-এ পড়েছি। এ জন্যই আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি। আর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা চাচ্চু আমাদের সবাইকে বলেছে। চাচ্চু বলেছে আমাদের সবাইকে আগামীকাল জাতীয় স্মৃতিসৌধ দেখাতে নিয়ে যাবে। আজতো আমার উত্তেজনায় ঘুমই আসছে না। বড় ভাইয়া বলছিল পুঁচকেদের যাবার কি দরকার? কিন্তু চাচ্চু বলেছে সবাইকে নিয়ে যাবে। বড় ভাইয়া রাজন ক্লাস নাইনে পড়ে। তাই ও অনেক বড় হয়ে গেছে, তাই না! আমি ক্লাস ফোরে পড়ি বলে ছোট নাকি?

চাচ্চু বলেছে রাজন ভাইয়া, রামিন ভাইয়া, অর্ষা আপু, মৌ আপু, আমি (বর্ষা), রোহান, মীম, আমরা সব ভাইবোন, কাজিন, আর পাড়াতো নোরা, ফারহানা, সাগর ওদেরও নিয়ে যাবে। এর জন্য বড় চাচ্চুর মাইক্রোটা নিতে হবে। বড় চাচ্চু অবস্য সহজে দেবে না। ছোট চাচ্চু বলেছে ম্যানেজ করে নিবে।

কিছুতেই ঘুম আসছে না। কি করে ঘুমাই! অনেক টেনশন হচ্ছে। সকাল সকাল উঠতে পারবো তো! নাকি না ঘুমিয়েই রাতটা কাটিয়ে দিব। চিন্তা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ে বর্ষা। রাজন আর বর্ষা হচ্ছে দুই ভাইবোন। সবসময় খুনসুটি লেগেই থাকে।

সকালবেলা রাজন বর্ষাকে ডেকে তুলে।
এই তোর সকালে ওঠা? দেখতো কয়টা বাজে?

কয়টা বাজে ভাইয়া?

তুই একদম ভুলে গেছিস। আজ না সকালে ওঠার কথা? আমরা সবাই স্মৃতিসৌধ দেখতে যাচ্ছি।

ও! সবাই বুঝি চলে এসেছে?

নারে বুদ্ধু তুই উঠে তৈরি হয়ে নে।

সবাই বর্ষার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে। বড় চাচা, ছোট চাচা, ওর বাবা। একে একে আসছে সব ভাইবোন। বর্ষার মা সবাইকে পরিবেশন করছেন। আজতো ছুটির দিন। তাছাড়া একটা বিশেষ দিন। তাই সবাই একসঙ্গে। এটা ওর বাবা চাচাদের পৈত্রিক বাড়ি। সবাই এই বাড়িতেই থাকে এবং একসঙ্গে থাকে। সবাই সবাইকে অনেক ভালবাসে।

বর্ষা আসতেই ওর মা ওকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে দেয়। আজ সকালে পরোটা হয়েছে। সাথে ডিম ভাজি, সবজি আর আছে কলিজা ভুনা। যে যেটা খেতে পছন্দ করে। আজ বিজয় দিবস উপলক্ষে মিষ্টিও আনা হয়েছে। পায়েস রান্না করা হয়েছে। আজ বাচ্চাদের মনে অনেক খুশি অনেক আনন্দ। বাবা চাচারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন।

–কোন দেশে বাস করছি আমরা? আমাদের এত সাধনায় পাওয়া স্বাধীনতা, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া। এই স্বাধীনতা কোথায় হারিয়ে যেতে বসেছে?
যে উত্তেজনা নিয়ে আমরা দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম, যে স্পিরিট ছিল পাক্ সেনাদের এ দেশ থেকে হটানোর জন্য, সেই স্পিরিটটা আজ নেই কেন তরুণদের মাঝে? এরাই কি আমাদের সন্তান?

এরা নেশা করে, এরা সন্ত্রাস করে, এরা ধর্ষণ করে। শিশুদেরকে মানবিকতা শিক্ষা দেয় না, নৈতিকতা শিক্ষা দেয় না। ফুলের মত শিশুরা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তাদের শিক্ষা নেই, তাদের পরনের কাপড় ছেড়া, তাদের খাবার নেই। এই আমাদের দেশ, ভাবতে খুব খারাপ লাগে। আমরা অনেক সময়ই কিছু করতে পারি না।

–বর্ষাদের পরিবারের সবাই ঈদে কিম্বা অন্য যে কোন সময়েও গরীব দূঃখিদের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। তারা নিয়মিত যাকাত প্রদান করেন। তাদের সাধ্যমত তারা চেষ্টা করেন।

এইসব কথাগুলো গুরুগম্ভীর লাগে বাচ্চাদের কাছে। তবু তারা শোনে, চুপ করে শোনে। কারণ কিছু বলতে গেলেই মা রেগে গিয়ে বলবে, খাবার সময় কথা বলতে নেই। বড়দের সামনে তো নয়ই।

রাজন একটু বড়। ও এক পর্যায়ে বলে, আচ্ছা ছোট চাচ্চু আমরা তো আজকে স্মৃতিসৌধ দেখতে যাব। সেখান থেকে ফিরে এসে আমরা যদি কিছু অসহায় গরীব বাচ্চাদের বই আর রঙপেন্সিল উপহার দেই? দেয়া যায় না চাচ্চু? বর্ষা ভাবে, বাহ্ ভাইয়ার মাথায় কত বুদ্ধি! ভাইয়া তো ঠিকই বলেছে। আমরা তো আমাদের জমানো টাকাটাও ব্যয় করতে পারি। রাজনের বাবা শুনে অবাক হয়। ছেলে সঠিক পথেই যাচ্ছে তাহলে। ওদেরকে সঠিক শিক্ষা দিতে হবে। ওরা যাতে মানুষের মত মানুষ হতে পারে সে চেষ্টাই তো সবসময় করে যাচ্ছে।  ওরা মানবিক গুন সম্পন্ন হোক। ছোট চাচ্চু বলে, হ্যাঁ সেটা আমরা করতে পারি। সব ভাইবোনেরা তাতে সায় দেয়।  এবং সবাই একমত হয় ওদের জমানো টাকা ওরা ব্যয় করবে।

রামিন অর্ষা ওরা বলে, আমরা তো— আমরা তো আজ বিজয় দিবস উপলক্ষে ঐ সব বন্ধুকে খাওয়াতেও পারি। বর্ষার বাবা বলে ছোট ভাইকে, শোন আসাদ তুই আমার কাছ থেকেও কিছু টাকা নিয়ে যাস। বাচ্চারা যা বলছে ওরা সেটা করুক। বড় চাচাও একই কথাই বলেন। এবং কিছু শুকনো খাবার কেনার জন্য টাকা দেন। বিস্কুট, পাউরুটি, কলা, কমলা এইসব।

আজ বাচ্চাদের সবার মনে অনেক আনন্দ। একটা ভালো কাজ করার আগে যে উৎসাহটা পাচ্ছে তাতে ওদের মন ভরে উঠেছে আর একটা দারুণ উত্তেজনাও কাজ করছে।
পাড়ার যাদের আসার কথা নোরা, ফারহানা, সাগর, তারা চলে এসেছে। আর বর্ষা রাজন রামিন অর্ষা মৌ মীম রোহান সবাই তৈরি। ছোট চাচ্চুও তৈরি। এখন ওরা বেরিয়ে পড়বে। বড় চাচার মাইক্রোটা নিয়েছে। ওরা বাগান থেকে ফুল সংগ্রহ করেছে। আজ যেন গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকায় ভরে ছিল বাগানটা। নোরা, ফারহানাদেরও জিজ্ঞেস করে বর্ষা, তোদের ফুল কোথায়? ফুল এনেছিস? ওরা হাত ভর্তি ফুল দেখায়।

ওরা সাভারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। নোরা ফারহানা আর সাগরকে ওরা ওদের প্ল্যানের কথা বলে। সবাই তাতে রাজি হয় এবং হৈ চৈ করে উঠে। আজ সারাদিনটা আমরা এভাবেই স্পেন্ড করবো।
ছোট চাচ্চু বলে, তোমরা তো সারা বছর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকো, এখন তোমাদের ফাইনাল পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেছে, আর এই সময় তোমাদের এই উদ্যোগটা সত্যিই প্রশংসনীয়। মাঝেমধ্যে এরকম করতে হয়। সবাই একসাথে বলে, হ্যাঁ চাচ্চু আমরা করতে চাই।

দেখতে দেখতে ওরা সাভারে চলে এসেছে স্মৃতিসৌধের কাছে। এবার গাড়ি থেকে নামে। সবাই ছোট চাচ্চুর সঙ্গে হাঁটে। আজ ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস হওয়ার কারণে অনেক লোকের সমাগম। এখানে সবাই স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের সম্মান জানাতে এবং বেড়াতে এসেছে। ভীড়ের মধ্যে একটু অসুবিধা হচ্ছিল তবু ওরা এগিয়ে যায়। এভাবেই তো এগিয়ে যেতে হবে। জাতীয় স্মৃতিসৌধকে কাছে থেকে দেখে বাচ্চারা। সৌধ চত্বরে মৃদু কন্ঠে ভেসে আসে দেশের গান। ওরা ধীরে ধীরে শহীদ বেদীতে গিয়ে নিয়ে আসা ফুলগুলো দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ভালবাসা জানায় শহীদদের প্রতি। স্মৃতিসৌধ চত্বরটি যেন মুখরিত হয়ে উঠেছে নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষের পদচারণায়। সাধারণের মনে খেলে যায় বিজয়ের আনন্দ। যেন এ দেশ আমাদের গর্ব আমাদের অহংকার। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের উচ্ছ্বসিত পদচারণা।

ছোট চাচ্চু আসাদ ওদেরকে বুঝিয়ে বলতে থাকে।
এই যে দেখছ স্মৃতিসৌধ এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি স্মারক স্থাপনা। এর নকশা করেছেন স্থপতি মইনুল ইসলাম। এখানে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের দশটি গনকবর রয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রনায়কগন সরকারিভাবে বাংলাদেশ সফরে এলে এই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

তোমরা কি দেখতে পাচ্ছো এখানে সাতটি ত্রিভুজাকৃতি মিনার রয়েছে। সবাই মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। তিনি আবার বলতে থাকেন, এই আমাদের দেশ। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা এই দেশ পেয়েছি। সেই শহীদদের স্মরণে এই স্মৃতিসৌধ নির্মিত। ১৯৮২ সালে এর নির্মাণ কাজ  সম্পন্ন হয়।
এ ছাড়াও রয়েছে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আল-বদর বাহিনীর হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে সেটি নির্মিত। সেই স্মৃতিসৌধের ফলক উন্মোচন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। এর স্থপতি মোস্তাফা আলী কুদ্দুস। সেখানে তোমাদের অন্য আরেক দিন নিয়ে যাব। এবার চলো আমাদের যেতে হবে। আর তোমরা সবাই কিন্তু এই স্মৃতিসৌধ দেখা বিষয়ের উপর রচনা লিখবে। দেখি তোমরা কে কি জানলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আর বিজয় দিবস সম্পর্কে।
বাচ্চারা সম্মতি দেয়।
চলো এবার আমরা এলাকায় ফিরে গিয়ে সমস্ত বাচ্চাদের নিয়ে দ্বিতীয় ধাপের আয়োজন করি। সবাই হৈ হৈ করে উঠে। চোখেমুখে নতুন এক অভিজ্ঞতার ছোঁয়া। ছোট চাচ্চু বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে না জানলে তোরা তো প্রকৃত মানুষ হতে পারবি না। তোদের বই পড়তে হবে। পারবি না তোরা সকলে মানুষ হতে?

সবাই বলে, পারবো চাচ্চু।
রাজন বলে, এই তো আমাদের ইতিহাস চাচ্চু। জানতে তো হবেই। কিছুক্ষণের জন্য পরিবেশটা থমথমে হয়ে উঠে। ওরা এলাকায় ফিরে আসে।

আসাদ চাচ্চু বলে, যা তোরা এলাকার সব গরীব বাচ্চাদের খুঁজে ডেকে নিয়ে আয়।
সবাই ছুটে যায় বস্তিতে বস্তিতে এবং রাস্তায়।
সকলকে একত্রিত করে। আসাদ সাহেব শুকনো খাবার আর ফল কেনার ব্যবস্থা করেছে। লোক পাঠিয়েছে। রামিন আর রাজন পাড়ার লাইব্রেরিতে চলে যায়, বই আর রঙপেন্সিল কিনতে। আসাদ সাহেবের নেতৃত্বে সবাইকে একত্র করে বিতরণ করে। এবং বিজয়-ভোজ রান্নার আয়োজন করে।
খিচুড়ি, গরুর মাংস আর সবজি ।

এই কাজ গুলো করতে পেরে বাচ্চারা আজ খুব আনন্দ পায়। গরীব বাচ্চাদের মুখেও অনেক হাসি। আজ উপহারগুলো পেয়ে ওরা অনেক খুশি।  এবং ওরা সকলে মিলে একসঙ্গে বিজয়-ভোজ খায়।
আজ এই আনন্দঘন দিনটি কাটিয়ে ওরা বাড়ি ফেরে। এবং নতুন একটা উদ্যম পায়। জীবনে চলার পথে এই উৎসাহ আর উদ্দীপনা ওদের অনেক দূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। এবং প্রতিটি বছর যেন এরকম ভালো দিন ফিরে ফিরে আসে। এবং প্রতি বছর প্রতিটি দিন আমরা যেন এই বিজয়ের চেতনাকে ধরে রাখতে পারি।

——“ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এরং দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি। আমরা তাদের কখনো ভুলবো না”।

বাড়ির ছাদে সকালেই লাল সবুজের পতাকা লাগানো হয়েছে। সেই পতাকা উড়ছে পতপত করে। সকলে ছাদে গিয়ে পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে  স্যালুট করে। এবং আবার গানটি গেয়ে ওঠে,

“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”।

অতিথি লেখক