ভয় বিলাসের ভয়াবহতা

ভয় বিলাসের ভয়াবহতা

ছবি: জবরুল আলম সুমন।

জবরুল আলম সুমন: খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এইতো বছর তিন-চার আগেও আমি প্রচন্ড রকমের ভূত এফ.এম এর ভক্ত ছিলাম। সে সময় ভূত এফ.এম-কে রিলেট করে ‘ভয়’ শিরোনামে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে একটা নোটও লিখেছিলাম। রেডিও ফুর্তিতে সর্বাধিক জনপ্রিয় এই অনুষ্ঠানটি লাইভ শোনা হতোনা খুব একটা। ডাউনলোড করে রাত এক-দেড়টার দিকে ঘরের সব আলো নিভিয়ে ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে একটানা শুনতাম। ভূতের অদ্ভুত সব ঘটনা শুনতাম আর ফিল করতাম, আমার সাথেই বুঝি এসব ঘটছে! অবাক হলেও সত্যি যে আমি ভীষণ ভয় পেতাম এসব ঘটনাগুলো শুনতে। চোখ বন্ধ করে কানে এয়ার ফোন গুঁজে যখন শুনতাম তখন চোখ খুলতেও ভয় লাগতো, মনে হতো চোখ খুললেই কিছু একটা দেখে ফেলবো! মজার ব্যপার হলো ওই সময়ে ওয়াশরুমে যেতেও ভয় লাগতো, অপারগ না হলে এটাচড ওয়াশরুমেও যেতাম না। এটা এক ধরনের ভয় বিলাসও বলা যেতে পারে। ভয়টাও যে এক ধরণের উপভোগ্য বিষয় তা ভূত এফ.এম না এলে অজানাই থেকে যেতো!

তবে ভয় আমরা শুধু ভূত এম.এম শুনেই পাইনা। নানান কারণেই আমরা ভয় পাই। কেউ কল্পনায় ভয়ে থাকেন আর কেউ জলজ্যান্ত বাস্তবতা দেখে ভয়ে মুষড়ে পড়েন। কেউ নিজের দোষে ভয় পান আর কেউ অন্যের আচরণে ভয় পান। কেউ বাজারে যেতে ভয় পান, কেউ ডাক্তারে যেতে ভয় পান। কেউ অন্ধকারে ভয় পান কেউবা আলোতেও ভয় পান। কেউ রাজনীতিবিদদের ভয় পান আর কেউ সন্ত্রাসীদের ভয় পান। বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসবাদের নতুন সংস্করণ হলো জঙ্গিবাদ! কিছুদিন আগেও আমাদের মানসপটে জঙ্গি মানেই ছিলো দাড়ি টুপিওয়ালা কোন মাদ্রাসার গরীব ছাত্র। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরপর দুটো জঙ্গি হামলা ও হামলার সাথে সম্পৃক্তদের চলমান গ্রেফতার অভিযানের কল্যাণে আমাদের সেই ধারণাটা পাল্টে গেছে। জঙ্গি মানেই দাড়ি টুপিওয়ালা কোন মাদ্রাসার বিত্তহীন ছাত্র নয়! জঙ্গি মানেও যে শীর্ষ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চ-শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তদের সন্তানরা হতে পারে তাতে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

ভয়কে উপভোগ করা ছেড়েছি বছর তিনেক আগে, কিন্তু এখন এক ধরনের ভয়ে থাকি সব সময়, যে ভয়টা কোন ভাবেই উপভোগ্য নয় বরং ভীষণ রকমের আতংকের! আমি আদৌ জানিনা কে জঙ্গি আর কে জঙ্গি নয়! আমার কাছা-কাছি থাকা কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়া যে ছেলেগুলোকে সারাদিন দেখি, নিপাট ভদ্রলোকের ভদ্র ছেলেরা! ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ায়াত করার সময় দেখা মাত্রই সালাম দেয়। কখনো কোন কিছু জিজ্ঞেস করলে চোখে চোখ রেখে উত্তর দেয়না, খানিকটা মাথা নুয়ে কথা বলে। ওদের মধ্যেও কি কেউ জঙ্গি? ওদের প্রায় সবাই’ই ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আছে। সেখানে তারা নিয়মিতই তাদের বিভিন্ন ছবি আপ করে! ঠিক নিব্রাস ইসলামের মতোই! তাদের তারুণ্যে ভরা সেসব ছবি কী আমাকে নিশ্চিত করতে পারে যে ওরা ধর্মীয় অনুশাসনের নামে জঙ্গিবাদে লিপ্ত নয়? আমি এমনিতেই ভীড় টির এড়িয়ে চলি, কিন্তু ইদানিং কোথাও কোন ভীড় দেখলে পাশ দিয়ে যেতেও ভয় লাগে! মনে হয় এই বুঝি ভীড়ের মধ্যে কোন জঙ্গি এসে একটা গ্রেনেড ছুঁড়ে মারবে! আমি মনে করি এই ভয়টা শুধু আমার একার নয়, দেশের অধিকাংশ মানুষেরাই এখন এই ভয়ে আতংকিত হয়ে আছেন।

আপনি আপনার সন্তানদের সুন্দর একটা ভবিষ্যতের লক্ষ্যে দিতে দিন রাত খেটে মরছেন। যখন যা চাইছে সাধ্য মতো তা পূরণ করার চেষ্টা করছেন। সারাদিন কাজ শেষে আপনি যখন বাসায় ফিরছেন তখন কখনো কোনদিন হয়তো বা তার পড়াশোনার খবর নিচ্ছেন, সে যা বলছে তাই বিশ্বাস করে চুপ করে থেকেছেন কিন্তু কখনো কি জানার চেষ্টা করেছেন পড়াশোনার বাইরে আপনার সন্তান কোথায় যাচ্ছে কার সাথে মিশছে বা কি করছে? এতোদিন হয়তো এই বিষয়টা অবহেলা করেছেন কিন্তু আর নয়। এখন সময় হয়েছে সচেতন হওয়ার। যে সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নে আপনি নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন সেই সন্তানই হয়তো হতে পারে আপনার অপদস্তের কারণ। তাই আপনার সন্তানকে সময় দিন, তাকে বুঝুন। তারমধ্যে কথা বার্তায়, আচার-আচরণে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করলে তার কারণ খুজে বের করুন। মায়েদের দায়িত্বটা এখানে আরোও বেশি। মায়েদের সাথে সন্তানেরা যতটা বন্ধুবৎসল হতে পারে বাবাদের সাথে হয়তো ততটা হতে পারেনা। তাই মায়েরা আরো বেশি সচেতন হোন, আপনার সন্তানের আরোও কাছা-কাছি থাকুন। হযরত আলী (রহঃ) এর একটা উক্তি ছিলো এরকম: “জ্ঞানী পুত্র পিতার আনন্দ বর্ধন করে আর নির্বোধ পুত্র মাতার কষ্টের কারণ।” তাই আপনার সন্তানকে জ্ঞানী করতে চেয়ে নির্বোধ বানাচ্ছেন কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব মায়েদেরই বেশি।

আপনি হয়তো প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখেন আপনার সন্তান বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যরিস্টার, ব্যবসায়ী, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ইত্যাদি ইত্যাদি হবে। কিন্তু কখনো কি ভাবেন আপনার সন্তান আগে মানুষের মতো মানুষ হোক। আপনার সন্তানকে আগে নৈতিক শিক্ষা দিয়ে মানুষ হিসেবে তৈরী করুন, মানুষ বানানোর দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিবেন না। তথা কথিত এইসব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান আপনার সন্তানকে ডাক্তার বানাতে পারে, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে পারে কিন্তু মানুষ বানাতে পারেনা।

[লেখক: জবরুল আলম সুমন, প্রাবন্ধিক।।]
shumonbg@gmail.com

অতিথি লেখক