রাজশাহী মেডিকেলে ঘটনা নিয়ে কথা

রাজশাহী মেডিকেলে ঘটনা নিয়ে কথা

শওগাত আলী সাগর: রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ঘটনাটির সূত্রপাত  ডা. সুব্রত নামে একজন চিকিৎসককে ঘিরে। সেই ডা. সুব্রত ঘটনা সম্পর্কে ফেসবুকে একটি বয়ান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন. “যে রোগীটা এসেছিল সেটি ছিল Conversion Disorder এর রোগী। আমি তাকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য পেইনফুল stimulus দেই। এবং তাকে ধমক দিয়ে টেনে তুলে বসানোর চেষ্টা করি। তাকে ধমক দেয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে তার সাথে থাকা attendant আমার উপর চড়াও হয়ে আমাকে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করে।  ডা. সুব্রত’র বক্তব্য অনুযায়ী রোগীর স্বজনদের সামনেই তিনি একজন Conversion Disorder এর রোগীকে ধমক দিয়ে টেনে তোলার চেষ্টা করেছেন।আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানুষ নই। তবে Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders এ  Conversion Disorder কে psychiatric disorder হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে Conversion Disorder এর রোগীরা নিউরোলোজিক্যাল সমস্যায় ভোগেন। সুব্রত’র কথা অনুসারে রোগীটি ‘মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায়’ এবং ‘অবচেতন’ অবস্থায় ছিলো্। সুব্রত নিজেই বলেছেন, তিনি রোগীকে পেইনফুল stimulus দিয়েছেন। সাধারনত কোনো রোগী যখন কথাবার্তায় বা স্বাভাবিক চেষ্টায় কোনো সাড়াশব্দ করে না তখন তার কনসাশনেস এর পরিমাপের জন্য পেইনফুল stimulus পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ডা. সুব্রত একজন ‘মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা’ ‘অবচেতন’ মানুষকে ‘ধমক দিয়ে টেনে বসানোর’ চেষ্টা করেছেন।(এটা ডা. সুব্রত’র বক্তব্য)।

পশ্চিমে কোনো চিকিৎসক এমনকি ইনজেকশন দেওয়ার সময়ও রোগীকে বা তার সঙ্গে থাকা এটেনডেন্টসকে জানান, তিনি এখন ইনজেকশন পুশ করতে যাচ্ছেন এবং সেটি সামান্য ব্যথা দেবে। ডাক্তার যে কাজটি করতে যাচ্ছেন সে সম্পর্কে রোগী এবং রোগীর স্বজনকে মানসিকভাবে আগেই প্রস্তুত করে নেন চিকিৎসক। বাংলাদেশেও হযতো অনেক চিকিৎসকই এই ধরনের আচরন করে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে ‘মেন্টাল ডিসঅর্ডার’ এর একজন রোগীকে ধমক দিয়ে টেনে তুলে বসানোর চেষ্টা করতে গেলেন কেন চিকিৎসক? এটাই কি একমাত্র ব্যবস্থা? যদি তাই হয় তাহলে ব্রিফ করে নিলে হয়তো  অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতো না। তারপরেও প্রশ্ন থাকে একজন চিকিৎসক রোগীকে ‘ধমক’ দিতে পারেন কী না। তাও আবার psychiatric disorder এর রোগীকে? সুব্রতর ভাষায় “তাকে (রোগীকে) ধমক দেয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে তার সাথে থাকা attendant আমার উপর চড়াও হয়ে আমাকে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করে।“ এই কাজটা মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। একজন কর্তব্যরত চিকিৎসক কেন একজন সাধারন নাগরিকের ওপর চড়াও হওয়ার কোনো রোগীর এটেনডেন্টসরা রাখেন না।

সুব্রত জানাচ্ছেন,” আমি রোগীর লোকের উপর রেগে গেলে সে আবার আমার উপর চড়াও হয়। আমি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বরত পুলিশ এবং পরিচালককে ঘটনাটি অবহিত করি।  সেই সাথে আমার সহকর্মী ডাক্তারবৃন্দকে ফোনে ঘটনাটি জানালে তারা আমাকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য ১৩ নং ওয়ার্ডের সামনে চলে আসে।“ সুব্রত বেশ চটপটে অবশ্যই। তিনি (১) রোগীর লোকের ওপর রেগে গেছেন, (২) পুলিশ ডেকেছেন (৩) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। ঘটনাটা এই পর্যন্তও হয়তো থাকতে পারতো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয ব্যবস্থা নিতে পারতো। কিন্তু সুব্রত তার সহকর্মীদেরও ডেকে পাঠিয়েছেন। এখানে এক ধরনের ট্রেড ইউনিয়নিজম কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। ডা. সুব্রত’র বক্তব্য অনুসারে ধারনা করা যায়, তিনি ঠিক চিকিৎসকসুলভ পেশাদার মুডে ছিলেন না। একজন চিকিৎসক রোগী থেকে সর্বত্রই যদি ধমকা ধমকি করেন , তাহলে তার সম্ভবত এই পেশায় না থাকাই ভালো।

২.  আমাদের সাংবাদিকদের অনেকেরই  ‘মাত্রা জ্ঞানের’ পরিধিটা যে  খুবই সীমিত এটা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। তারা মনে করেন, দেশের সর্বত্রই তাদের প্রবেশাধিকার আছে, তারা যে কোনো স্থানে যেতে পারেন। হাসপাতাল একটি স্পর্শকাতর জায়গা, বিশেষ করে রোগীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্যই এর প্রবেশাধিকার সীমিত রাখা হয়। কোনো একটি হাসপাতালের কর্মরত চিকিৎসক ওই হাসপাতালের কর্মচারী। তিনি চাইলেই মিডিয়ার সাথে হাসপাতাল নিয়ে, চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে পারেন না। যদি না প্রতিষ্ঠান তাকে সেইরকম অনুমতি দেয়।

পশ্চিমে, এই কানাডায়ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে বড় বড় অভিযোগ ওঠে, রোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসক গ্রেফতারও হন, কিন্তু মিডিয়া হাসপাতালে ছুটে যায় না। এমনকি যতোক্ষণ না পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দেয় ততক্ষন  হাসপাতাল বা ক্লিনিকের নামও মিডিয়া প্রকাশ করে না। আর হাসপাতালের কড়িডোরে সাংবাদিকদের ঘুরাফেরা? প্রশ্নই আসে না।কিন্তু বাংলাদেশে? মরনাপন্ন রোগীর পাশেও টিভি ক্যামেরা ভিড় করে।

সাংবাদিকদের যেমন পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও সচেতনতা দরকার, চিকিৎসকদের দরকার ধীরস্থির মানসিক অবস্থান। অসংখ্য মানুষের জীবন মৃত্যু তাদের মানসিক অবস্থার ওপর সাথে সম্পৃক্ত। ‘রেগে থাকা’ বা রেগে যাওয়া’ ধমকা-ধমকি করার প্রবণতাগুলোকে আকড়ে রেখে একজন চিকিৎসকের চিকিৎসাসেবার দায়িত্ব পালন সম্ভব না উচিৎও না। আমাদের চিৎিসকরা এই বিষয়টা বিবেচনায় নেবেন আশা করি।

[শওগাত আলী সাগর: সম্পাদক,নতুনদেশ ডট কম]

অতিথি লেখক