৭০ শতাংশ ওষুধের মান সম্পর্কে ওষুধ প্রশাসনের ধারণা নেই!

৭০ শতাংশ ওষুধের মান সম্পর্কে ওষুধ প্রশাসনের ধারণা নেই!

বিশেষ প্রতিনিধি, এসবিডি নিউজ২৪ ডট কমঃ অধিদফতরে উন্নীত হওয়ার দুই বছরেও দরকারি জনবল পায়নি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। ফলে ওষুধের মান ও দাম নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে ওষুধ কোম্পানি ও ফার্মেসির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না। এ ছাড়া ওষুধ আইনের কিছু সংশোধনও দরকার বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে পরিদফতর থেকে অধিদফতরে উন্নীত হলেও বাড়েনি জনবল ও সক্ষমতা। রাজধানীর মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার একটি সরকারি ভবনের একটি মাত্র ফ্লোর নিয়ে চলছে এর প্রধান কার্যালয়ের কার্যক্রম। আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওষুধ পরীক্ষাগার দুটিতে দরকারের মাত্র অর্ধেক ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করা যাচ্ছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় ঢাকায় আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন পরীক্ষাগার স্থাপনের কাজ শেষ হওয়ার পথে। ২৫৮টি ওষুধ কোম্পানি ও ৯০ হাজার লাইসেন্স পাওয়া ফার্মেসির তত্ত্বাবধান, ওষুধের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে রয়েছেন মাত্র ১৩৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী।

অধিদফতর চায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমেই যেন ওষুধ আইনে দোষীদের শাস্তি দেয়া যায়। ওষুধ শিল্প ও দেশীয় বাজারে ওষুধ বিক্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, দেশের বাজারে বিপুল পরিমাণ ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ আছে। এ ছাড়া চোরাই পথে অনেক বিদেশি ওষুধ আসে। কিন্তু নিয়মিত বাজার পরিদর্শন করার মতো জনবল ওষুধ প্রশাসনের নেই। দেশের ১২ হাজার কোটি টাকার ওষুধের বাজার তত্ত্বাবধান, ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ, ওষুধ কোম্পানি ও ফার্মেসিগুলোর লাইসেন্স দেয়া ও দাম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের। কিন্তু মান জানার জন্য অধিদফতর বছরে সাড়ে ৩ হাজার ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করতে পারে। বাকি সাড়ে ৮ হাজার অর্থাৎ ৭০ শতাংশ ওষুধের মান সম্পর্কে প্রশাসনের ধারণা নেই। এ তালিকায় ভিটামিন থেকে শুরু করে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ রয়েছে। সরকারিভাবে ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিষ্ঠান দুটি। একটি ওষুধ প্রশাসনের অধীনে চট্টগ্রামে অবস্থিত এবং অপরটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের অধীনে ঢাকায় অবস্থিত। চট্টগ্রামের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে নিয়োজিত রয়েছে মাত্র ১১ জন লোক এবং ঢাকায় ৪২ জন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে ওষুধের উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত কোনো স্তরেই সরকারি পরীক্ষাগারের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না। বিপণনের পর অধিদফতরের কর্মকর্তারা বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠান। তখন মান জানা সম্ভব হয়। বর্তমানে মান না জানা ওষুধই সেবন করছে মানুষ।
জানা গেছে, দেশের ৬৪টি জেলায় একজন করে ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক (ড্রাগ সুপার) প্রয়োজন। কিন্তু ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক আছেন মাত্র ২৯ জন। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় কর্মরত রয়েছেন ১৪ জন। বাকি ১৫ জন দিয়ে ৬৩টি জেলার ও গ্রামাঞ্চলের কার্যক্রম চলছে। ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রকোনা, এই চার জেলার জন্য রয়েছেন একজন ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক। ওষুধ প্রশাসনের যানবাহন সংকট দীর্ঘদিনের। কোনো কারখানা পরিদর্শনে বা বাজার পরিস্থিতি দেখার জন্য প্রশাসনের লোকজন গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না। ঢাকা থেকে গাজীপুর কারখানা পরিদর্শনে যাওয়ার সময় ওষুধ কোম্পানির গাড়ির ওপর নির্ভর করতে হয় বলে জানা গেছে। এ রকম আরো বেশকিছু ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনের লোকরা ওষুধ কোম্পানির সহায়তা নেন। ফলে প্রশাসনের লোকরা ওষুধ কোম্পানির অনেক বিষয় চেপে যান।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মুক্তাদির জানান, ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করার অনুমোদন আছে ২৫৭টি প্রতিষ্ঠানের। তবে সক্রিয় আছে ১৯৩টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ৪০টি প্রতিষ্ঠান ৯৫ ভাগেরও বেশি ওষুধের জোগানদাতা। বাকি ১৫৩টি প্রতিষ্ঠান মাত্র ৪ দশমিক ৪২ ভাগ ওষুধ উৎপাদন করে। তিনি বলেন, অনেক অসাধু ব্যবসায়ী বড় প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে বাজারে নকল ও ভেজাল ওষুধ বিপণন করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক আ ব ম ফারুক বলেন, ওষুধের মান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া খুবই জরুরি। পরপর দুবার বাংলাদেশে মানহীন ওষুধ সেবনে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, নকল ও ভেজাল ওষুধের কারণে কিডনি, যকৃৎ, হৃদযন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক ওষুধ উৎপাদকরা বাজারে আনেন। কিছু ওষুধ আমদানি হয়, কিছু আসে চোরাই পথে। মান জানতে হলে বছরে কমপক্ষে ২৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, বহু ভিটামিনের মোড়কে ১৮টি খনিজ উপাদান থাকার ঘোষণা আছে। সত্যি আছে কি না তা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা সরকারের পরীক্ষাগারে কখনো ছিল না, এখনো নেই। অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, রাতারাতি পরিবর্তন আসবে না। এ ক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। কর্মকর্তারাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জনবল ও যন্ত্রপাতির সংকট কাটাতে পারলে অবস্থার পরিবর্তন হবে।

বিশেষ প্রতিনিধি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।