বাংলাদেশের রাজনীতিঃ ভয়াবহ এক বিপর্যয় অবিশ্যম্ভাবী!

বাংলাদেশের রাজনীতিঃ ভয়াবহ এক বিপর্যয় অবিশ্যম্ভাবী!

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ স্যামুয়েল জনসন বলেছেন, ‘স্বদেশপ্রেম পাজি লোকের শেষ অবলম্বন।’ যদি এ বক্তব্যকে আক্ষরিক সত্য হিসেবে ধরে নেই, তবে জর্জ ওয়াশিংটন, চার্চিল, লিঙ্কন, গান্ধী, জিন্নাহ, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, ভাসানী এবং জিয়া সবাই দুষ্টলোক ছিলেন। বাস্তবতাই প্রমাণ করে যে এরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক ছিলেন এবং সুযোগ সন্ধানী ছিলেন না। যা-ই হোক, যদি অসৎ লোকেরা দেশপ্রেমের পোশাকে আবৃত হয়, তবে তা হল ভন্ডামি, যাকে আদৌ দেশপ্রেম বলা যায় না।

রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যম; তাই রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টির শুরু থেকেই। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে তার প্রতি মানুষের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় কার্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা, নেতৃত্ব কলুষিত হয়ে গেলে মানুষের ভাগ্যে নেমে আসে অবধারিত দুর্যোগ। বাংলাদেশে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই; এখানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন ব্যবসায়ী ও টাকাওয়ালারা, প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদরা এ টাকাওয়ালাদের কাছে এক প্রকার জিম্মি। সারা জীবন যিনি রাজনীতির জন্য জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করলেন, জীবন উৎসর্গ করলেন, পরিবারের সদস্যদের সময় না দিয়ে রাজনীতির মাঠ তৈরি করলেন, তৈরি করলেন অগণিত নেতাকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষী- দেখা গেল একজন টাকাওয়ালা ব্যক্তি এসে হঠাৎ তার স্থান দখল করে নিলেন। এমনকি কোন দোষ ছাড়া, কোন কারণ দর্শনো নোটিশ ছাড়া; শুধু টাকার জোরে কেন্দ্র থেকে একজন রাজনীতিবিদকে বহিষ্কার পর্যন্ত করতে সমর্থ্য হন ওই ব্যবসায়ী এবং টাকাওয়ালারা। কী আশ্চর্যের ব্যাপার! রাজনীতির নামে এখানে এই নীতিই চর্চা ও লালন করেন দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পর্যন্ত! তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!
এটিই বর্তমানে বাংলাদেশের প্রকৃত রাজনীতির চেহারা; এখানে প্রতিষ্ঠিত ও তারকা রাজনীতিকরা আজ পরিহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় কোন নীতিনির্ধারণী কাজে তাদের মহামূল্যবান মেধা ব্যয়িত হচ্ছে না। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বা কোন আলোচনা অনুষ্ঠানে তারা উপদেশ ফিকির করে বেড়াচ্ছেন। এই যদি হয় রাজনীতির চেহারা, তাহলে এই রাজনীতি মানুষের কল্যাণ করবে কি করে? এই রাজনীতি তো মানুষের কোন উপকারে আসছে না! হাজার কোটি, লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেও মানুষের কোন সমস্যার সমাধান হচ্ছে না! মানুষের সামনে শুধু সমস্যার পাহাড় তৈরি হচ্ছে! যিনি রাজনীতিতে টাকা বিনিয়োগ করেন, তিনি তো ব্যবসার উদ্দেশ্য নিয়েই তা করেন; জনসেবা তার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। তিনি তো নেতা নন, সাধারণ মানুষের কাছে তার তো কোন দায়বদ্ধতা নেই। টাকাই যদি রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে থাকে, তাহলে রাজনীতির নামে সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই ভন্ডামির দরকার কী? দরকার কী সভা-সেমিনারে বসে নীতিকথা বলার? যে রাজনীতি মানুষের কোন কল্যাণে আসে না, সে রাজনীতি তাসের ঘরের মতো ধসে পড়তে বাধ্য। আজ হোক কাল হোক, এ রাজনীতি অবধারিত ধসে পড়বে। হাতে হারিকেন নিয়ে অন্ধ সেজে দায় থেকে কারওই রক্ষা হবে না। ভয়াবহ এক বিপর্যয় অবিশ্যম্ভাবী এ কলুষিত নেতৃত্বের জন্য।

দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে নাগরিকদের প্রতিটি কাজে, সিদ্ধান্তে এবং আচরণে জাতীয় গর্বের প্রতিফলন ঘটতে হবে। এ প্রতিফলন কেবল দেশের অভ্যন্তরে পারস্পরিক আচরণে ঘটলেই চলবে না, প্রতিটি নাগরিক একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে একজন অতিথি আপ্যায়নে কিংবা প্রবাসে অবস্থানকালীন একই আচরণ বজায় রাখতে হবে। দেশীয় অহংকার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হতে হবে।
নিজের দেশকে ভালোবাসা মানে অন্যের দেশকে ঘৃণা করা নয়। নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণের জন্য অন্য জাতিকে হেয় করাকে অবাস্তব দেশপ্রেম বলা হয়। এ গ্রহের অংশীদার হিসেবে আমরা পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আপনি যা করবেন, তা আমাকে প্রভাবিত করবে এবং আমার কাজ আপনার ওপর বর্তাবে, এ কারণেই পারস্পরিক সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক মূল্যায়নের ওপর প্রতিটি দেশের কাঠামো প্রস্ত্তত হয়।
আমরা কি সত্যিই সভ্য সমাজে বাস করি? কোথায় ন্যায়বিচার? একে কি গণতন্ত্র বলে? একি আমাদের সংস্কৃতি? এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, প্রতি বছর শতকরা ৫০ ভাগ ছাত্র অন্য দেশে পাড়ি জমায়। কারণ যে ব্যবস্থা সৎ লোকের সাজা ও অসৎদের পুরস্কৃত করে, সেখানে তারা থাকতে চায় না। একেই কি জাতীয় লজ্জা বলে না? আমাদের যুবকরা হয় সুন্দর জীবনের জন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছে, নয়তো অবিশ্বাসী কিংবা দূষিত হয়ে পড়ছে। মাত্র ২০ বছর আগেও বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় কাউকে যদি প্রশ্ন করা হতো, ‘কবে ফিরবেন?’ উত্তর আসত, ‘কয়েক বছরের মধ্যে’। তারা বলত, ‘কিছু টাকা জমিয়ে পড়াশোনা শেষ করেই ফিরে আসব।’ কিন্তু বর্তমানে কোন বাংলাদেশী তরুণ দেশ ছাড়ার সময় প্রশ্ন করলে তার জবাব আসে ভিন্ন রকম। সে জানায়, ‘আমি আর ফিরে আসছি না, আমি ওখানেই থেকে যাব।’ এর মানে কি তারা তাদের দেশকে আর ভালোবাসে না?
আমরা নৈতিক রক্তাল্পতা ও আত্মিক ক্যান্সারে ভুগছি। সৎ ও ন্যায়বান লোকেরা দুর্নীতি ও আর্থিক অপুষ্টির মধ্যখানে পরিহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছে। এখানে নানা ধরনের অপরাধী রয়েছে- খুনি, ধর্ষক, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজ। যারা জাতির সঙ্গে প্রতারণা করে তারা নিকৃষ্টতম অপরাধী। পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে রয়েছে আমাদের সামাজিক নিন্দা। একজন পতিতা তার বেঁচে থাকার তাগিদে শরীর বিক্রি করে। কিন্তু একজন বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক লোকের কবলে পুরো জাতিই বিক্রি হয়ে যায়। কোনটি নিকৃষ্টতর?

প্রায় তিন হাজার বছর আগে গ্রিক সভ্যতার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক ও দার্শনিকরা (আদর্শ রাষ্ট্রে) বিধান দিয়েছিলেন, দার্শনিক রাজার না থাকবে কোন পরিবার, না থাকবে কোন ব্যক্তিগত সম্পদ। পরিবার না থাকলে আত্মীয়স্বজন বা সন্তান-সন্ততির প্রতি তার কোন সময় দুর্বলতা জন্মাবে না। ব্যক্তিগত সম্পদে অধিকার না থাকলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহারে তিনি নিজেই উদ্বুদ্ধ হবেন।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রকৃতি হতে হবে উদার-নৈতিক, সংকীর্ণমনা নয়। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিত্ব হতে হবে সৃজনমুখী; হতে হবে সংবেদনশীল, কঠোরমনা নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে জনগণের আমানত হিসেবে গণ্য করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজেদের প্রভাব, বৈভব বা প্রতিপত্তি অর্জনের মাধ্যম হতে পারে না। কোথাও কোন পর্যায়ে কোন বিচ্যুতি ঘটলে ঠিক তখনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিত্যাগ করার মানসিকতা তাদের অর্জন করতে হবে।
লালসা ও বিলাসিতার জন্য জাতির সর্বনাশ করার মতো প্রতারক ও বিশ্বাসঘাতক প্রত্যেক সমাজে রয়েছে। এ ধরনের লোকেরা হীনমন্যতা ও অহংবোধের প্রভাবে যে কোন মূল্যে ক্ষমতা, সম্পদ ও মর্যাদা পেতে চায়। বেনেডিক্ট আরনল্ড ছিলেন এমনই এক বিশ্বাসঘাতক। আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় তিনি গোপনে ব্রিটেনে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তার দেশের লোকজন এ ষড়যন্ত্র টের পেলে তিনি ইংল্যান্ড পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। যখন তিনি ইংল্যান্ড থাকতেন, কেউ তার সঙ্গে কথা বলত না, এমনকি নিজেদের চারপাশে তাকে দেখতেও চাইত না। তিনি জনগণের সামনে চরমভাবে অপমানিত হতেন। এমনও হয়েছে, কিছু লোক তার মুখের ওপর থুথু ছিটিয়ে দিত। তিনি যেখানে যেতেন, বিশ্বাসঘাতকতার কলংক তাকে অনুসরণ করত, তাকে সবাই ‘বিশ্বাসঘাতক বেনেডিক্ট আরনল্ড’ নামে ডাকত।

বর্তমানে আমাদের রাজনীতিবিদগণও কি এমন আচরণ করেন না? একেই কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলে না? সবসময়ই আমরা অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাই। মাশুল দিই উত্তরোত্তর। ইতিহাস আমাদের যে শিক্ষা দেয়, তা হল আমরা আদৌ কিছু শিখিনি। ব্রিটিশরা যখন সমগ্র বাংলাকে তাদের দখলে নিতে চাইল, নবাবের উচ্চাকাঙ্ক্ষী মন্ত্রী মীর জাফর তাদের সাহায্য করল। পরে নবাব হওয়ার আশায় মীর জাফর তার শাসনকর্তা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরামর্শ দিলেন পলাশীর প্রান্তর থেকে সৈন্যদল ফিরিয়ে নিতে, যদিও ব্রিটিশ বাহিনীকে হটানোর জন্য তারা প্রাণপণ যুদ্ধ করছিল। নবাব তার বিশ্বস্ত মন্ত্রীর উপদেশ গ্রহণ করে তার রাজত্ব এমনকি জীবন পর্যন্ত হারালেন। মীর জাফর এভাবে মাতৃভূমির সঙ্গে বেইমানি করে তা তুলে দিলেন বিদেশী দখলদারের হাতে। লোভই বিশ্বাসঘাতকদের একমাত্র ধর্ম। সে তার ব্যক্তিগত লাভের জন্য শয়তানের সঙ্গে একপাত্রে চুমুক দিতে পারে।

আমরা প্রায়ই শুনি, ‘ক্ষমতা দূষিত করে এবং ক্ষমতা সম্পূর্ণ দূষণ সম্পন্ন করে’। এ কথা সত্য নয়, ক্ষমতা তাদেরই দূষিত করতে পারে, যারা দূষণযোগ্য। ক্ষমতা কেবল অন্তরালকে সম্মুখে এনে দেয়। ক্ষমতা নিরপেক্ষ। সৎ লোকের হাতে ক্ষমতা আশীর্বাদস্বরূপ, আর অধার্মিকের হাতে তা অভিশাপ। ক্ষমতার অপব্যবহার হয় তখনই যখন কারও প্রত্যাশা নোংরা হয়ে যায়। পাজি, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক লোকেরাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাজের মধ্যে দুর্নীতি ডেকে আনে।
যেসব নেতা উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ বস্ত্ত রেখে যেতে পারেন, তারা মহান আদর্শ এবং প্রতিশ্রুতির গভীর বোধ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। আন্তরিক নেতা শুধু বর্তমান বিষয় নিয়ে নয়, আগামীকাল তথা পরবর্তী সময়ের কথাও ভাবেন। এ ধরনের নেতৃত্ব ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে থাকে। আত্মবিশ্বাস, সাহসিকতা ও অনমনীয়তার শক্তি বলে যেসব ব্যক্তি নেতৃত্বের পর্যায়ে উন্নীত হন, ইতিহাস তাদের বিশেষ স্থান দিয়েছে।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।।
সম্পাদক, এসবিডি নিউজ24 ডট কম।

প্রধান সম্পাদক