সন্তানের ভালোবাসায় নিপাত যাক ‘বৃদ্ধাশ্রম’

সন্তানের ভালোবাসায় নিপাত যাক ‘বৃদ্ধাশ্রম’

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: শিশু বা প্রবীণ নেই এমন ঘর,এমন একটা পরিবার খুব কমই আছে৷ কিন্তু শিশু আর প্রবীণেরা সমাজে আজও নানাভাবে অবহেলিত৷ শিশুশ্রম দূর করতে হলে সমাজের সকল মানুষকে,রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে৷ কারো যদি সামর্থ থাকে একজনকে সাহায্য করুন৷ এভাবে একজন একজন করে সাহায্য করলে অসহায় শিশুর সংখ্যা কমবে৷ এই সংখ্যা কমলে শিশুশ্রমের মতো ভবিষৎ ধ্বংসকারী কাজ বন্ধ হবে৷আবার দেখা যায়, কিছু পরিবারের বাবা-মা বৃদ্ধ হলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে পরিবারগুলোয় যে অশান্তির আগুন,বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্ব,সমাজে যে অস্থিরতা,যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়,অপসংস্কৃতি,নগ্নতার সয়লাব,অধার্মিকতার চূড়ান্ত মাত্রা তা রোধে নবীন-প্রবীণের সহযোগিতা ও সহমর্মিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার বিকল্প নেই৷ বিশেষ করে প্রবীণরা তো পরিবার ও সমাজের ভিত্তি৷ প্রত্যেক প্রবীণ ব্যক্তিই কোনো না কোনো দিক থেকে আমাদের শিক্ষক৷ তাঁদের থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা,প্রত্যক্ষ সহযোগিতা,তাঁদের জ্ঞান ওঅভিজ্ঞতা ছাড়া আমরা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখবো কীভাবে?

বৃদ্ধাশ্রমের সূচনা: পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতারিত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গাই দখল করে নিয়েছে এই শান রাজবংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশের সব রকম ব্যবস্থাই। ছিল খাদ্য ও বিনোদনব্যবস্থা। ইতিহাসবিদেরা এই বৃদ্ধাশ্রমকে প্রাচীন চীনে গড়ে ওঠা সভ্যতারই অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিহিত করেছেন। বৃদ্ধাশ্রম বৃদ্ধ নারী-পুরুষের আবাসস্থল। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্য,চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সমগ্র বিশ্বে জীবন প্রত্যাশার মান বৃদ্ধি করে জনমিতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে সমগ্র বিশ্বে বৃদ্ধ নর-নরীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের নর-নারীর গড় আয়ুও বৃদ্ধি পেয়েছে। একবিংশ শতাব্দীকে কেউ কেউ বার্ধক্যের যুগ বলেও উল্লেখ করেছেন। তবে বার্ধক্যের মোকাবেলা করা বিশ্ব সমাজের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের প্রভাব: বালাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম ও ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। বার্ধক্য বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ যার মোকাবেলা নিতান্তই কঠিন। জাতিসংঘ ৬০ বছর বয়সকে বার্ধক্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ হিসাবে জনসংখ্যার ৬.১ শতাংশ প্রবীণ নর-নারী। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়েবে ১০.১ শতাংশে। উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশে এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর হয়ে দেখা দিবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ সাধারণ পরিবারে বসবাস করেন এবং তাদের ভরণপোষণ,চিকিংসা ইত্যাদির ভার সন্তানদের ওপর বর্তায়। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক,মানসিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের কারণে যৌথ পরিবারে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এতে করে প্রবীণরা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্থাৎ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ প্রবীণেরই কোন না কোন সন্তান বাইরে থাকে। অর্থাৎ এদের সঙ্গে পিতামাতার যোগাযোগ খুব কম হয়। এতে করে বৃদ্ধ পিতামাতারা আর্থ-সামাজিক সমস্যায় ভোগেন। বাংলাদেশে শতকরা ২০ জন হয় একাকী থাকেন অথবা স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে থাকেন। দরিদ্র প্রবীণদের সংখ্যা শতকরা ৩৭ জন।

একটি গল্প: ছোট্ট একটি গল্পের আলোকপাত করি। বৃদ্ধ বাবা এবং তার তরুণ সন্তান এক সকালে পার্কে হাটছিলেন। হঠাৎ একটা পাখি দেখে বাবা তার সন্তানের কাছে জানতে চাইলেন,বাবা ওটা কি পাখি? সন্তান বলল টিয়া। বাবা আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা ওটা কি পাখি? ছেলে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলল,বললাম না ওটা টিয়া। বাবা আবারও জিজ্ঞাসা করলেন,ওটা কি পাখি? এবার সন্তান মেজাজ চড়া করে বলল শুনতে পাওনি ওটা টিয়া। বাবা পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন,বাবা ওটা কি পাখি ? সন্তান এবার আর পাখির নাম বাবাকে বলে নি। বলেছে,তোমার সমস্যা কি। পাগল হয়ে গেলে নাকি। একটা কথা এতবার বললাম তারপরও তুমি বারবার জিজ্ঞাসা করছ,কি পাখি ! মেজাজ খারাপ করে কতক্ষন বাবাকে মন্দ বলে ছেলে পার্কের বেঞ্চে বসে পড়ল । বাবা ছেলেকে সেখানে একটু সময় বসতে অনুরোধ করে বাসায় এসে একটি ডায়েরী নিয়ে আবারও ছেলের কাছে ফিরে গিয়ে ডায়েরীটা তাকে পড়তে বলল। ডায়েরীটা পড়ে ছেলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল এবং বাবার কাছে বারবার ক্ষমা চাইতে লাগল।

এটা গল্পের প্রথম অংশ। অনুমান করতে পারছেন,ডায়েরীতে কি লেখা ছিল? বাবা এই ডায়েরীটা তার ছেলের বয়স যখন ৪ বছর তখন লিখেছিলেন। তখনও বাবা তার কৌতুহলী ছেলেকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে এসেছিলেন। ছেলে একটি টিয়া পাখি দেখে বাবার কাছে ৩২ বার জানতে চেয়েছিল বাবা ওটা কি পাখি। বাবা বিরক্ত হননি বরং প্রতিবার উত্তর দিয়েছিলেন। বাবা তার ডায়েরীতে লিখেছিলেন,আমার সন্তান আজ আমার কাছে একটি পাখি দেখে ৩২ বার তার নাম জানতে চেয়েছিল এবং আমি প্রত্যেক বার তাকে পাখিটির নাম বলেছি এবং আমার কলিজার টুকরা প্রত্যেকবারই আনন্দ পেয়েছে। পাঠক গল্পটা এখানে শেষ হয়নি। আমাদের সমাজে বারবর আবর্তিত হচ্ছে এই ধরনের গল্প। তবে সে সকল গল্পে বাবার কাছে সন্তানের ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্য খুব কম বরং শেষ জীবনে এসে বাবা-মাকে সন্তানের কাছ থেকে দূরে সড়িয়ে দেয়া হয়। সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের আশ্রয়ের স্থলে বাবা-মাকে আশ্রয় নিতে হয় কোন বৃদ্ধাশ্রমে। কিছু ব্যতিক্রমও অবশ্যই আছে যেখানে বাবা-মা ইচ্ছা করেই শেষ জীবনে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেন। তবে সে সংখ্যা খুব কম বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়েই পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়। সময় যত অগ্রসর হবে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যাও তত বাড়বে এবং পিতা-মাতার সাথে সন্তানদের দূরত্ব তৈরি হবে । উন্নত বিশ্বের যে সকল রাষ্ট্র মুনফাভিত্তিক সমাজ কাঠামো গড়ে তুলেছে সেখানে পিতা-মাতা বৃদ্ধ হলে তাদেরকে অনুৎপাদক জনসংখ্যা হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া হয় কিন্তু আমাদের দেশের কি ততোটা পরিবর্তন এসেছে?

পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা: যে সমাজে মাত্র কয়েক বছর পূর্বেও একান্নবর্তী পরিবারের অস্তিত্ত্ব ছিল কিংবা এখনো বড় পরিবার কেন্দ্রীক পারিবারিক কাঠামো বিদ্যমান সেখানে বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজনীয়তা কেন? উন্নত বিশ্বে সন্তানের বয়স ১৮ পেরুলেই পিতা-মাতা তাকে স্বাবলম্বী করে নিজেরা আলাদ করে থাকতে পছন্দ করে কিন্তু আমাদের দেশের অবস্থা কি ততোটা পরিবর্তনে হয়েছে। যে সমাজে ৩০ বছর পর‌্যন্ত সন্তানকে পিতা-মাতা লালন করে সেখানে সন্তান একটু স্বাবলম্বী হলেই কেন পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমের দিকে পা বাড়াতে হবে? দেশে যে হারে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে তাতে নচিকেতার বিখ্যাত বৃদ্ধাশ্রম গানটির বাস্তব অবস্থা দেখতে বোধহয় খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। আজ যে সন্তান তারা পিতা-মাতাকে জোড় করে কিংবা এমনভাবে অবহেলা করছে যাতে তারা বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য হয় সেই সন্তানকেই যখন তার সন্তান এভাবেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে তখন তার কেমন লাগবে? সন্তান যখন বেশি সুখ ভোগ করার আশায় তার অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায় তখন তার বিবেক ঘুমিয়ে থাকে কেমনে? সময় বড় বেরসিক। আবর্তিত হয়ে বদলা নেবেই। বৃদ্ধ হলে মানুষ শিশুর মত আচরণ করে কিন্তু যে সন্তানটি আজ পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে যে যখন দীর্ঘ কয়েক বছর পিতা-মাতাকে অসহ্য যন্ত্রনা দিয়েছে তখন তো পিতা-মাতার একবারের জন্যও সন্তানকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়ার চিন্তা আসেনি। যে সন্তান পিতা-মাতাকে মানসিক কিংবা অন্যকোনভাবে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য করে সে সন্তানের ভেবে দেখা উচিত তার পরিণতি কেমন হবে। পিতা-মাতাকে যতই কষ্ট দেয়া হোক না কেন তারা তাদের সন্তানদের জন্য অকল্যান কামনা করবে না কিন্তু সময় তো তার আপন ধর্মেই বদলা নেবে ।

অনুসন্ধান: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের তথ্যমতে,বাংলাদেশে বর্তমানে ১ কোটি ৩০ লাখের মতো প্রবীণ রয়েছেন। বাংলাদেশের  মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭ শতাংশ প্রবীণ এবং বাংলাদেশের প্রবীণদের ৭৮ শতাংশ বিধবা। রাজধানীর আগারগাঁও প্রবীণ হাসপাতাল নিবাসে (বৃদ্ধাশ্রমে) ৪৫ জন নারী রয়েছেন। আরও বাড়ছে বলে কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে। গাজীপুরের হোতাপাড়ার মনিপুর এলাকায় মুকুলের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে মোট ১২০০ মানুষ থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে বসবাসরত এই কেন্দ্রে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই নারী। সাভার বৃদ্ধাশ্রম এবং সমাজসেবা অধিদফতরের বৃদ্ধাশ্রমেও বাড়ছে বয়সী মায়েদের মুখ। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়,২৭ লাখ ২২ হাজার ৫০ জনকে জনপ্রতি মাসিক বয়স্কভাতা দেয়া হয় ৪০০টাকা। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

শেষ কথা: পিতা-মাতার পাশে মানবতার অন্যতম একটি কলংকিত নাম হলো বৃদ্ধাশ্রম,সত্যিই যাহা বেমানান এবং দুনিয়ার সবচেয়ে ঘৃনিত আবাসের নামটিও বৃদ্ধাশ্রম। ভাবতে  অবাক লাগে যেই  পিতা-মাতা এত কষ্ট করে সন্তান্দের লালন পালন করে বড় করলো, শিক্ষিত করলো আর সেই সব সন্তানেরা পিতা-মাতা বৃদ্ধ হলে কিভাবে তাদের বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে পাঠাতে পারে! এত নির্মমমতা কিভাবে আপন সন্তানেরা অসহায় পিতা-মাতার প্রতি করে থাকে। সেই সব সন্তানেরা কি একটুও ভাবেনা কোন একদিন তাদের জীবনেও এই রকম পরিনতি আসতে পারে। তারাও একদিন ‘বৃদ্ধাশ্রম’ নামক কলংকিত কারাগারে নিক্ষিপ্ত হতে পারেন,আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সমাজের শিক্ষিত অংশেই এই বৃদ্ধাশ্রম সংস্কৃতিটা বেশী পরিলক্ষিত হয়। তাই আজ বলতেই হয় শিক্ষিত হওয়ার পরও সেই সব সন্তানেরা মানুষ হতে পারেনি। এক নির্ভেজাল সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি আমরা এবং আমাদের সমাজ। বর্তমান প্রজন্মের মুখ থেকে শুনতে চাই,তারা যেন ‍দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করে,“আমাদের পিতা-মাতার জন্য কোন বৃদ্ধাশ্রম নির্মানের প্রয়োজন নেই”। ক্ষনিকের সুখ পেতে কেউ যেন দীর্ঘস্থায়ী সুখ ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ পিতা-মাতাকে নির্বাসনে না পাঠায় । যে গৃহে পিতা-মাতা আছে সে গৃহের সুখ কোন পার্থিব সম্পদের বিনিময়ে বদল করা আদৌ সম্ভব নয়। প্রতিটি সন্তানের কাছে বিনীত অনুরোধ,বাবা-মা যেন কোন ব্যাপারে কষ্ট না পায়। মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর‌্যন্ত যেন তারা তাদের সন্তানদের কাছ থেকে হাসি মুখ দেখতে পায়। কেননা পরিবারই কেবল পিতা-মাতার নিরাপদ আবাস স্থল হতে পারে।

[শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: প্রধান সম্পাদক,এসবিডি নিউজ24 ডট কম।।]

jsb.shuvo@gmail.com

প্রধান সম্পাদক