সিলেটে ২৪ হাজার ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে!

সিলেটে ২৪ হাজার ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে!

সুমন দে,সিলেট প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ24 ডট কমঃ সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে কয়েক দফা ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় ডেঞ্জার জোন সিলেটের বাসিন্দাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ ও মোকাবেলার কোনো প্রস্ত্ততি না থাকায় আতঙ্ক আরো ঘনীভূত হচ্ছে।

জানা যায়, সিলেটে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হলেও পূর্ণতা না পাওয়ায় তা কাজে লাগছে না। স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সেরও ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলার সামর্থ্য নেই। এমতাবস্থায় সিলেট নগরী ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকার ২৪ হাজার ভবনে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে বিশাল জনগোষ্ঠী। রিখটার স্কেলে ৬ থেকে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই এসব ভবন ধসে পড়বে। আর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। জনমানব শূন্য বিরানভূমিতে পরিণত হতে পারে সিলেট নগরীসহ বেশকিছু এলাকা। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ভবন কোড না মেনে সুউচ্চ স্থাপনা নির্মাণের ফলে মাঝারি মাত্রার ভূকম্পন হলেই ধ্বংসসত্মূপে পরিণত হতে পারে সিলেট নগরী।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৪৮ সালে প্রচন্ড ভূমিকম্পে সিলেট এলাকায় ব্যাপক ভূ-পরিবর্তন ঘটে। উঁচু-নিচু ভূমি সমতলে পরিণত হয়। এরপর ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৮১২ ও ১৮৬৯ সালের ভূমিকম্পে সিলেটের মানচিত্র পাল্টে যায়। সিলেটে এ যাবৎকালের মধ্যে ১৮৯৭ সালের ১২ জুন বিকাল সোয়া ৫টার দিকে সংঘটিত ভূমিকম্প ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থ কোয়াক’ নামে পরিচিত। ৮ দশমিক ৭ মাত্রার সেই ভূমিকম্প ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ বর্গ কি.মি. এলাকায় পাকা দালানকোঠার ব্যাপক ÿতিসাধন করে। শুধু সিলেট জেলাতেই ভেঙে পড়ে ৫৪৫টি ভবন। বাড়িচাপা পড়ে প্রচুর মানুষ মারা যায়। এ ভূমিকম্পে সৃষ্টি হয় বিশাল আকারের হাওর, বিল ও জলাশয়ের, যা আজো বিদ্যমান। এরপর ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই সিলেটের শ্রীমঙ্গলে ভূমিকম্প ব্যাপক ÿতিসাধন করে। এর তীব্রতা ছিল ৭.৬।

২০০৯ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) পরিচালিত জরিপে উলেস্নখ করা হয়, সিলেট অঞ্চলে ৫২ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ২৪ হাজার ভবনই ভূমিকম্পের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ। সেই জরিপ অনুযায়ী দেশে ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। সে সময় ওই জরিপের ফলাফল আশঙ্কাজনক বলে মমত্মব্য করেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। তারা বিল্ডিং কোড অমান্যকারীদের বিরম্নদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিলেও আজো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এজন্য ভূমিকম্পকে ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার অব ডিজাস্টার’ (এসওডি)-এর অমত্মর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পের ভয়াবহ ঝুঁকিতে থাকলেও এ অঞ্চলে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত জরাজীর্ণ ভবনের সংখ্যা কতো তার হিসাব নেই সিলেট সিটি করপোরেশন ও গণপূর্ত বিভাগে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব উদ্যোগে ২০০৬ সালে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, সিলেটে একশ থেকে দেড়শ বছরের প্রাচীন শতাধিক ভবন রয়েছে। সিলেট মহানগরীতেই এ ধরনের স্থাপনা রয়েছে শতাধিক।

ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত সরকারি স্থাপনাগুলো হচ্ছে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার, জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়, জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক কর্মকর্তার কার্যালয়, কাস্টমস অফিস, সিলেট সাব পোস্ট অফিসের ফরেন রেমিটেন্স ভবন ও সিটি মার্কেট। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এসব জরাজীর্ণ ভবন এখন অনেকটা মৃত্যুকূপ। প্রায় ৪ বছর আগে সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নগর ভবনের পাশেই সিলেট সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন সিটি মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয় ৮ বছর আগে। ২৪ বছর আগে ১৯৮৬ সালে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের অধিকাংশ স্থাপনাই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত হয়। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত জরাজীর্ণ দোতলা ভবনে জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়, জিন্দাবাজারে জেলা খাদ্য নয়ন্ত্রক কর্মকর্তা ও কাস্টমস অফিসের কার্যক্রম চলছে। মহানগরীর দক্ষিণ সুরমার বঙ্গবীর রোডে জরাজীর্ণ ভবনে চলছে সিলেট সাব পোস্ট অফিসের ফরেন রেমিটেন্স শাখার কার্যক্রম।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূ-কম্পন অনুভূত হওয়ার পর মেয়াদোত্তীর্ণ ও জরাজীর্ণ এসব ভবন, স্থাপনা নিয়ে শঙ্কা বেড়েছে। সরকারি ভবন ও স্থাপনার পাশাপাশি মহানগরীতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক আবাসিক ও বাণিজ্যিক জরাজীর্ণ বহুতল ভবন রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক দশকে সিলেট মহানগরী ও এর আশপাশে ব্যাপক হারে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, বিপণি বিতান ও আবাসন প্রকল্প। এসব ভবনের অধিকাংশেরই নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এদিকে বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের অনুমতি নেয়া হলেও নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। দ্বিতল ভবনের অনুমতি নিয়ে ৫ তলা ভবন নির্মাণ করলেও তা তদারকির কেউ নেই। তাছাড়া মহানগরীর অধিকাংশ ভবন নির্মিত হয়েছে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করেই। সয়েল টেস্ট ছাড়া এসব ভবন নির্মাণের কারণে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সিভিল ডিফেন্স এন্ড ফায়ার সার্ভিস-সিলেটের উপ-পরিচালক পরিমল কন্ডুু জানান, সিলেট নগরীর তেলিহাওরের ফায়ার স্টেশনে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র ৩৫ জন। এ ছাড়া নগর পার্শ্ববর্তী দুটি উপজেলায় এ বিভাগের আরো ৪৯ জন কর্মরত রয়েছেন। লোকবল বা সরঞ্জামাদি ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ দুর্যোগ ও পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়। তবে আপদকালিন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য গত ৩ বছরে প্রায় ২ হাজার সেচ্ছাসেবক তৈরি করা হয়েছে। সিলেটের মতো দ্রম্নত বর্ধিষ্ণু নগরে কমপক্ষে আরো ৩-৪টি ফায়ার স্টেশন থাকা দরকার। ইতোমধ্যে নগরীর বটেশ্বর এলাকায় একটি ফায়ার স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরম্ন হয়েছে। তবে আশঙ্কার কথা, তেলিহাওরে নগরীর একমাত্র ফায়ার স্টেশন ভবনও ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে।

এসবিডি নিউজ ডেস্ক